মুসলিম গবেষককে ‘টেরর’ বললো কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য
সাস নিউজ : এ যেন হীরক রাজার দেশ। রাজা শংকর কুমার ঘোষ। দেশের নাম কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়। যা খুশি তাই করছেন, যা খুশি তাই বলছেন। লোকসংস্কৃতি বিভাগের গবেষক রাজেশ খান তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য দীর্ঘ তিন মাস অপেক্ষা করেছিলেন। বারংবার চিঠি ও মেইল করেও কোন উত্তর মেলেনি। অবশেষে গবেষক আশ্রয় নিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা দফতরে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সচিব সুকান্ত আচার্য্যর হস্তক্ষেপে অবশেষে উপাচার্য দেখা করার সময় দেন ৩১শে জানুয়ারি। রাজেশ খানের দেখা করার উদ্দেশ্য ছিল পিএইচডিতে ভর্তি। তার দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারেই শঙ্কর ঘোষ তাকে বলে ‘তুমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের টেরোর হয়ে গেছো’। শিক্ষিত মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে, একজন উপাচার্য কি কোন ছাত্রকেই টেরোর বলতে পারেন ?
উল্লেখ্য গত ছমাস ধরে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনগ্রসর শ্রেণির কয়েকজন পড়ুয়া উপাচার্য শঙ্করকুমার ঘোষের বিরূপ মানসিকতার শিকার বলে জানা গেছে। দেখুন উপাচার্য শঙ্কর ঘোষ কি বললেন ওই গবেষককে…
তার বর্তমান অদক্ষ প্রশাসন পরিচালনে শঙ্করবাবু বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িকতার অনল ছড়িয়েছেন। তিনি দলিত, পিছড়ে বর্গ ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিতে মরিয়া বলে ঐ পড়ুয়াদের কয়েকজনের দাবি। ১৯২৯ সালে লাহোর কংগ্রেসের সভাপতি জহরলাল নেহরু ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকাতে কোনও স্বাধীন ভূখন্ডে সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রসঙ্গে নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনা মতো দেশবিভাগের পর সদ্য স্বাধীন দেশের গন পরিষদের এক সদস্য জানিয়েছিলেন, পাকিস্তান তার সংখ্যালঘুদের কী অধিকার দেয়, তার ভিত্তিতে এ দেশের সংখ্যালঘুদের অধিকার স্থির করা হবে। তখন পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ওই বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। আজন্ম কাল ধরে এ দেশে মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ। বাংলার সব এলাকায় প্রতি ভোরে আজান, মন্দিরের কাসর ঘণ্টা, গির্জার ঘণ্টা পর পর শোনা যায়। এ যেন ‘অডিবেল সেক্যুলারেজম’। সাত সাত বারের বাম শাসনে ভীতু বাঙালি মুসলিম তাঁদের আত্মপরিচয় হারিয়েছিল। শুনতে হয়েছিল, কৌমী মাদ্রাসাগুলিতে সন্ত্রাসী বানানো হয়।
পালাবদলে অবস্থা বদলাচ্ছে। সংরক্ষণের দৌলতে সরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনগ্রসরদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ছে। দেশের অন্যান্য প্রদেশে ঈগল স্বরুপ বড় পাখি (সংখ্যাগরিষ্ঠ) ক্ষুদ্র পক্ষী সংখালঘুদের ছৌ মেরে শেষ করে দেয়। এ সবের থেকে আলাদা অষ্টাদশ শতকের নবজাগরণের ধাত্রীভূমি বাংলা।
কিন্তু বর্তমান সরকারের এক নীতি, আর সেই নীতিরই বিরুদ্ধে অবস্থান শঙ্করবাবুর। মাস ছয়েক আগে শঙ্করবাবু অনুমতি দেন, সদ্য এমফিল শেষ করা কয়েকজন পড়ুয়াকে সরাসরি পিএইচডিতে ভর্তির নেওয়া হবে। সেই মোতাবেক অনেকেই ভর্তি হলেও নবনীতা বর্মন, রাজেশ খান সহ আরও কয়েকজন ভর্তি হতে পারছেন না। একাধিক চিঠি-চাপাতি করলেও উহ্য রয়েছে তাদের ভর্তি না হবার ব্যাপারটি। কিছুদিন আগে তারা উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানে উপাচার্য রাজেশকে সরাসরি ‘টেরর’ বলেন। এতে রাজেশের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত লাগে। সভ্যতার সংঘাত এই যুগে দাঁড়িয়ে সকলেই জানেন, টেররের বাংলা প্রতিশব্দ সন্ত্রাস বা আতঙ্ক। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটা যথেষ্ট অবমাননাকর শব্দ।
বহু বার হত্যে দেওয়া সত্ত্বেও ভর্তি সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের ন্যায্য এবং বিধিসম্মত দাবি শুনতে চাননি শঙ্করবাবু। শেষমেশ তারা উচ্চশিক্ষামন্ত্রী মাননীয় শ্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের দ্বারস্থ হন। মন্ত্রী মহোদয়ের কার্যালয়ের আধিকারিকদের ফোনাফুনির জেরে খানিকটা চাপে পড়ে দিন কয়েক আগে উপাচার্য তাদের সঙ্গে দেখা করতে সম্মত হন। রাজেশ জানিয়েছেন, আমি উপাচার্যের ঘরে ঢুকতেই তিনি আমাকে ‘টেরর’ বলেন।
প্রশ্ন হল, দেশের সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে, সম অবস্থায় সম পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আইন সমান ভাবে প্রযুক্ত হবে। এখানে যে নির্দেশ বলে বহু পড়ুয়া পিএইচডিতে ভর্তি হলেন, সেই একই নির্দেশ কী ভাবে তাদের ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দলিত, সংখ্যালঘু, অন্যান্য পিছড়ে বর্গের পড়ুয়ারা যাতে ভর্তির ক্ষেত্রে অসাম্যের শিকার না হন, সে দিকে বিশেষ ভাবে নজর দিতে বলেছে। থোরাট কমিশনের রিপোর্ট ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাহীন পড়ুয়াদের অবদলিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছিল। কিন্তু প্রগতিশীল বাংলাতেও এখন দেখা যাচ্ছে, শঙ্করবাবু সামাজিক ও আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নীরবে অত্যাচার করছেন বলে অনেকের দাবি। তিনি হদ্দ গ্রামের গরীব ছাত্রদের সঙ্গে শীতল যুদ্ধে নেমেছেন। কেন এই একতরফা যুদ্ধ? এর উত্তর দিতে হবে শঙ্করবাবুকে বলে ওই পড়ুয়াদের মত।
বিভিন্ন জনের বিরুদ্ধে উপাচার্য নিজে উদ্যোগী হয়ে একাধিক ছাত্র-ছাত্রীদের লেলিয়ে দিয়ে অত্যাচারের মিথ্যা নালিশ করিয়েছেন। বানিয়েছেন তদন্ত কমিটি। কমিটির এক অতি উচ্চ পর্যায়ের আধিকারিক সওয়াল-জবাবের পর রাজেশকে জানিয়েছেন, তোমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ষড়য়ন্ত্র করা হচ্ছে। এর ভিডিও রাজেশের কাছে রয়েছে। আর এই চক্রান্তের কাজে উপাচার্য কয়েকজন বামপন্থীকে পেয়েছেন। ওই বামেরা দীর্ঘদিন ধরে মুসলিমদের দাবিয়ে রেখেছিল। আজও তাঁরা সক্রিয় শঙ্করবাবুর বদান্যতায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ঘুষ নেওয়া, বিএড কলেজে ভর্তির নাম করে টাকা তোলা, যৌন হেনস্থা সহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। একটি অভিযোগের তদন্ত করার সিদ্ধান্ত কর্মসমিতি অনুমোদন করলেও আজও তার জন্য কমিটি গড়েননি উপাচার্য। বিধি ভেঙ্গে ছাত্র ভর্তি, ছাত্র ভর্তি আটকে রাখা, ডীন হবার পরেও টিউশন দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যাপক তপন কুমার বিশ্বাসের নামে অভিযোগ রয়েছে। বাংলা বিভাগের এক প্রাক্তন পড়ুয়ার দাবি, ওর কাছে টিউশনে যারাই পড়তে যায় তারাই ক্লাসে প্রথম বা দ্বিতীয় হয়। এসব নিয়ে নানান অভিযোগ হলেও উপাচার্য দীর্ঘদিন ধরে নিরুত্তর থেকেছেন। কী অভিসন্ধি আছে এর পিছনে ? ঘুষখোররা বহাল তবিয়তে এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এ রাজ্যে উচ্চশিক্ষায় মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব মেরেকেটে সাত শতাংশ। এটা দলিতদের থেকেও কম। হান্টার থেকে সাচার-সব রিপোর্টেই প্রকাশ পেয়েছে মুসলিমদের করুণ চিত্র। পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজ আজ প্রাগ্রসর সমাজের সঙ্গে মেশার সুযোগ পান না। ফলে এগিয়ে থাকা সমাজ লৌহ যবনিকার অন্তরালে থাকা মুসলিম জনসমাজ সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে। ফলে দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যেকার ব্যবধান বাড়তেই থাকে। এর জন্য তো দরকার ছিল মুসলিমদের শিক্ষা। শিক্ষিত মুসলিম সর্ব স্তরেই থাকবে। ফলে আলোকপ্রাপ্ত হিন্দু ভাইয়েদের সঙ্গে তাদের মেলামেশার সুযোগ শতগুণ বাড়বে। তখনই ব্যবধান কমবে দুই সমাজের। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির হিমেল বাতাস বইবে। কিন্তু হায়, শঙ্করবাবু সেই কাজ না করে তিনি তো উল্টে মুসলিম ছাত্রের ভাবাবেগে আঘাত করছেন। তাঁকে ‘টেরর’ আখ্যা দিচ্ছেন। তাঁদের কি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া করতে মরিয়া ওই উপাচার্য? উঠছে প্রশ্ন।
টাইমস্ বাংলা
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন