হিন্দুত্ববাদীদের বেপরোয়া হামলায় কাঁদছে বহু মুসলিম পরিবার
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সেদিন বাবা যখন মুদি দোকানে যাচ্ছিলেন, তিন বছরের মেয়ে হয়তো চকলেটের বায়না ধরেছিল। এক বছরের ছেলেটাও হয়তো আমতা আমতা করে কিছু বলেছিল। গাল দুটোয় আদর দিয়ে বাবা হয়তো বলেছিলেন ‘আচ্ছা’। দুই সন্তানই তাই বাবার পথের দিকে চেয়ে থাকছিল, কখন বাবা কোলে তুলে মুখে চকলেট পুরে দেবেন। কিন্তু সেই বেলা বাবা এলেন না, এলেন না রাতেও। দুই সন্তানকে পিঠে নিয়ে ঘোড়া ঘোড়া খেলা বাবা পরদিনও এলেন না। এলেন গত বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি), কজন লোকের কাঁধে চড়ে, খাটিয়ায়, সাদা কাপড়ে।
বাবা এভাবে এলেন কেন? তার দেহটা এমন নিথর কেন? নাকে-কানে সাদা ওসব কী গুঁজে দেয়া? ছেলেটা কিছু বলতে না পারলেও মেয়েটার এমন প্রশ্ন বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছিল স্বজনদের। কাঁপা কাঁপা স্বরেই স্বজনরা বললেন, তোমাদের বাবা মারা গেছেন। এই শেষবারের মতো এলেন। এবার গেলে আর কখনো আসবেন না তোমাদের কোলে নিতে, তোমাদের আদর করতে, বুকে জড়িয়ে নিতে।
প্রথম বাক্যটা না বুঝলেও ‘আর কখনো আসবেন না’ বুঝে যেন ডুকরে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। এই কান্নায় যেন গাছের পাতা ঝরে পড়ে, ভারী হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। সান্ত¡না দেবেন কী, মেয়েটার কান্নার সঙ্গে যেন হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন স্বজনরাও। দাফন করতে আসা পড়শীদেরও চোখ টলমল করতে থাকে। স্বয়ং মৌলভী সাহেবও অশ্রু লুকোতে পারেন না।
সাম্প্রদায়িক আইন সিএএ ও এনআরসিকে ঘিরে দিল্লিতে দাঙ্গায় প্রাণ হারানো অটোরিকশাচালক মুদাসসির খানের ওই স্বজনদের এ কান্নার ছবি এখন ভাইরাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কেউ সে ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘কাঁদে দিল্লি কাঁদে মানবতা’। কেউ লিখেছেন, ‘এই কান্না বিশ্ববাসীর জন্য অভিশাপ’। আবার কেউ লিখেছেন, ‘এ কান্না ভারতবর্ষের’।
কলকাতার প্রখ্যাত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা দাঙ্গার নৃশংসতা নিয়ে প্রতিবেদন করেছে এ ছবিটি ওপরে দিয়েই। শিরোনাম করেছে- ‘এ যেন ইন্ডিয়া-পাকিস্তান বর্ডার’! ‘নরক হয়ে গেল চেনা রাজধানী’।
সংবাদমাধ্যম জানায়, গত ২২ ফেব্রুয়ারি দিল্লির জাফরাবাদে সিএএ-বিরোধীরা রাস্তা অবরোধ করে। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে সিএএর পক্ষে ক্ষমতাসীন বিজেপির মদতপুষ্ট উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা পাল্টা সমাবেশ শুরু করে। এরপরই দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। আর এই বিক্ষোভই সহিংসতায় রূপ নেয় এবং রণক্ষেত্রে পরিণত হয় দিল্লি।
সংঘাত-সহিংসতায় থমথমে অবস্থার মধ্যেই ২৫ ফেব্রুয়ারি নিকটস্থ মুদি দোকানে সদাই করতে যাচ্ছিলেন কর্দমপুরীর বাসিন্দা অটোচালক মুদাসসির খান। কিন্তু উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তার মাথায় গুলি করে। তখন তাকে নিকটস্থ জিটিবি হাসপাতালে নেয়া হলেও চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন মুদাসসির খানকে।
হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত হওয়ার বৃহস্পতিবার তার মরদেহ স্বজনদের বুঝিয়ে দেয়া হয়। এরপর মুদাসসিরের মরদেহ কর্দমপুরীতে তার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। তখনই কান্নায় ভেঙে পড়েন মুদাসসিরের স্ত্রী-সন্তানসহ স্বজনরা। পরে তাকে নিকটস্থ গোরস্থানে দাফন করা হয়।
মুদাসসির খানের মতোই উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের বাঁধানো দাঙ্গায় এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। এছাড়া পুলিশের সামনেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-মসজিদসহ মুসলিমদের অসংখ্য বাড়িঘর ও দোকানপাটে বেছে বেছে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দিল্লি।
দাঙ্গা সহিংসতার পর ভারতের রাজধানী দিল্লির বিভিন্ন স্থানে এখন একেবারে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দিল্লির উত্তর-পূর্বের যেসব শহরে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সেখানকার লোকজন এখনও চাপা উত্তেজনা আর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী (সিএএ) আইনকে কেন্দ্র করে গত রোববার থেকে দিল্লির উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন শহরে দাঙ্গা-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এতে এখন পর্যন্ত ৩৮ জন প্রাণ হারিয়েছে। অপরদিকে আহত হয়েছে আরও তিন শতাধিক মানুষ।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এর আগে কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। গতকাল জুমুয়াবার থেকে এসব বিধি-নিষেধ কমে আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত শনিবার জাফরাবাদে সিএএ-বিরোধীরা রাস্তা অবরোধ করে। রোববার থেকে পাল্টা সিএএর পক্ষে সমাবেশ শুরু হয়। এরপরেই দু’পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষ শুরু হয়। আর এই বিক্ষোভই সংঘাতে রূপ নেয় এবং দিল্লি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিভিন্ন স্থানে বেছে বেছে মুসলিমদের ঘর-বাড়ি এবং দোকানপাটে হামলা চালানো হয় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে কমপক্ষে তিনটি মসজিদে আগুন দেয়া হয়েছে। কিছু স্থানে পুলিশকে দুর্বৃত্তদের সহযোগিতা করতে দেখা গেছে। এছাড়া অশোক নগরের স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, একটি মসজিদে হামলা চালিয়ে ইমাম এবং মসজিদের এক রক্ষীকে মারধর করেছে পুলিশ। পরে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন