সৌদি-ইরান সংঘাত জ্বলে উঠতে পারে পাকিস্তান
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:মার্কিন অবরোধের ফলে তেহরান অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার কয়েক দশকের প্রতিদ্বন্দ্বিতা একটি জটিল সময়ে আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠতে পারে। সাম্প্রতিক সঙ্ঘাত শুরু হয়েছে তেলের দাম নিয়ে মতভিন্নতার মধ্য দিয়ে। ইরানি তেল সরবরাহে যেকোনো ধরনের বিঘ্নতার ক্ষেত্রে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য বিশ্বকে আরো সস্তায় তেল দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে রিয়াদ। মার্কিন অবরোধের দ্বিতীয় ধাপের ফলে ইরানি তেল রফতানি, জাহাজ চলাচল, ব্যাংকের ওপর বিপর্যয়কর প্রভাব পড়েছে, যা ইরানি অর্থনীতির মর্মমূলে আঘাত হেনেছে।
ইরানি তেল রফতানি দিনে প্রায় এক মিলিয়ন ডলার হ্রাস পাওয়ায় দেশটির প্রধান রাজস্ব আয়ই কমে গেছে। শতাধিক বড় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি, গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংক, তেল রফতানিকারক ইরান থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে।
জ্বালানি সরবরাহে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ও বাজারের আরো বড় অংশ দখল করার জন্য তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে রিয়াদ। এশিয়ার বাজার ধরে রাখা এবং সৌদি তেলের সাথে পাল্লা দিয়ে ইরান ব্যবসা ধরে রাখার চেষ্টা করেছে।
চীন ও ভারতের মতো বড় বড় ক্রেতার ওপর ভর করে ইরান অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে রক্ষা পেতে পারত। কারণ মার্কিন চাপ সামাল দেয়ার মতো শক্তির পাশাপাশি জুন পর্যন্ত ছাড় রয়েছে চীনের। চীন তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে বিশ্ববাজারের মোট সরবরাহের এক তৃতীয়াংশ কেনে। আর তা ইরানি প্রয়োজনকে মেটানোর জন্য খুবই দরকারি। তবে বেইজিং তার তেল সরবরাহে কোনো ধরনের বিলম্ব মেনে নিতে পারে না। এই সুযোগটি গ্রহণ করে ইরানের যেকোনো ধরনের শূন্যতা পূরণ করতে প্রস্তুত হচ্ছে সৌদি আরব।
এশিয়া হলো তেলের পরবর্তী-প্রজন্মের মূল্যবান বাজার। পাশ্চাত্য বিকল্প জ্বালানি সমাধান পেলেও এশিয়ার মর্যাদা অটুট থাকবে। চীন, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো আগামী কয়েক দশকে প্রধান তেল রফতানি বাজার হিসেবেই বিরাজ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নতুন অর্থনৈতিক কৌশলকে আরো এগিয়ে নিতে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান সম্প্রতি ইসলামাবাদ, নয়া দিল্লি ও বেইজিং সফর করেছেন। তেল শোধনাগার ও এ সম্পর্কিত প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে রিয়াদ গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পাকিস্তানের বন্দর নগরী গোয়াদার থেকে সৌদি আরব বিশেষভাবে উপকৃত হবে। এই বন্দর দিয়ে সৌদি আরব মাত্র সাত দিনে চীনে তেল সরবরাহ করতে পারবে। ফলে এটিই সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার জন্য প্রধান বেস স্টেশন হতে পারে।
এটা প্রায় উইন-উইন অবস্থা। অবশ্য এর একটি বিপরীত চিত্রও আছে।
এশিয়ার তেল বাজারের একটি বড় অংশ থেকে তেহরানকে সৌদি আরব বঞ্চিত করার ফলে ইরান চাইবে না তার খুব কাছাকাছি জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান করুক। ইরানের সাথে পাকিস্তানে দীর্ঘ মরু সীমান্ত রয়েছে। আর ভারতের সাথে তৈরি হতে থাকা ইরানি বন্দর চাবাহার থেকে গোয়াদারের দূরত্ব মাত্র ১৭৫ মাইল। আরো খারাপ বিষয় হলো, সিরিয়া ও ইয়েমেনের প্রক্সি যুদ্ধে ইরান ও সৌদি আরব পরস্পর বিপরীত দিকে রয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এসব উত্তেজনাকর বিষয়ের প্রেক্ষাপটে রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পাকিস্তানকে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। উভয় দেশকে হাতে রাখার মতো করে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করা সহজ কাজ নয়। সাম্প্রতিক অতীতে ইয়েমেন ইস্যুতে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করার ফলে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছিল পাকিস্তান। আবার ২০১৫ সালে সৌদি আরব যখন সন্ত্রাস প্রতিরোধ করতে ইরান, ইরাক ও সিরিয়াকে বাদ দিয়ে ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্স গঠন করে পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল রাহিল শরিফকে এর প্রধান করেছিল, তখন ইরান ব্যাখ্যা চেয়েছিল।
এখন পর্যন্ত গোয়াদারের প্রতি হুমকি বিবেচিত হয়নি চাবাহার। ইরানের দক্ষিণ উপকূলে বন্দর আব্বাসের উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। ফলে চাবাহার ইরানের জন্য একটি বিকল্প মাত্র। আবার ইরান যদি সিপিইসি বা সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায় যোগ দেয়, তবে এটি হতে পারে গোয়াদার বন্দরের সহযোগী। তবে এখন তা সুদূরের ঘটনা বলে মনে হচ্ছে। ইরান এখন সম্ভবত চাবাহারকে গোয়াদারে সৌদি উপস্থিতির প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাবে।
একই ধরনের শঙ্কা অনুভব করে পাকিস্তানের সাবেক বন্দর ও জাহাজ চলাচলবিষয়ক মন্ত্রী মির হাসিল খান বিজেনজোহাস সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গোয়াদার হলো ইরানের চাহাবারের কাছে। আর রেকো দিক প্রকল্পটি জাহেদানের (ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী) কাছে। সুন্নি জঙ্গিরা (তারা সৌদি ওয়াহাবি মতাদর্শের অনুসারী) ওই এলাকায় সক্রিয়। তাহলে কেন গোয়াদারে সৌদি আরবের বিনিয়োগে তেহরান উদ্বিগ্ন হবে না?
উত্তপ্ত সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে অতীতেও সমস্যা ছিল, পাকিস্তান ২০১০ সালে ইরানের অনুরোধে সুন্নি বিদ্রোহী নেতা আবদুল মালেক রিগিকে গ্রেফতার করেছিল। তবে এখন কোনো গোলযোগ হলে ইরান হয়তো সৌদি আরবকে দায়ী করবে। এর ফলে চাবাহার হতে পারে গোয়াদার বন্দরের নিরাপত্তা প্রতিদ্বন্দ্বী। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য পাকিস্তানকে কঠোর নিরপেক্ষতা অবলম্বন করতে হবে, সে দুই দেশের মধ্যে সম্প্রীতি কামনা করতে পারে।
একইসাথে সৌদি-ইরান সম্পর্কে সমন্বয় সাধনও (উভয় পক্ষের মধ্যেই কট্টরপন্থী থাকলেও) সব পক্ষের জন্য সেরা বিকল্প হতে পারে। রিয়াদ ও তেহরান উভয় পক্ষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দেশ বিবেচিত পাকিস্তান তাদের মধ্যকার ভুল বুঝাবুঝি অবসানে ভূমিকা রাখতে পারে। মুসলিম পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে পাকিস্তান সৌদি আরবের নিরাপত্তা প্রশ্নের সমাধানে গুরত্বপূর্ণ দেশ। পাকিস্তানে রয়েছে ইরানের বিশেষ স্বার্থ। ইরানের পর পাকিস্তানেই রয়েছে দ্বিতীয় বৃহত্তম শিয়া জনসংখ্যার উপস্থিতি।
এ ধরনের মধ্যস্ততার বিষয়টি উপলব্ধি করে গত বছর নির্বাচিত হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জোর দিয়ে বলেছিলেন, আমাদের লক্ষ্য হবে মধ্য প্রাচ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়াস চালানো। আমরা ওই ভূমিকা পালন করতে চাই। নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করার আশাবাদ ব্যক্ত করে ইরানও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফকে পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল।
গত বছর প্রথমবারে মতো ইরান পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফরে সৌদি আরব গিয়েছিলেন, যদিও ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিই প্রথম আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা চেয়েছেন ইমরান। বোধগম্যভাবেই ইরানের কাছে একই কামনা করার প্রশ্নই ছিল না। কারণ মার্কিন অবরোধের কারণে ইরান রয়েছে অর্থনৈতিক সঙ্কটে।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন