সিকিমের রাজাকে যেভাবে অপসারণ করেছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’
সাস নিউজ ডেস্ক : ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা (র) অতি গোপনে দুই বছরের বেশি সময় তৎপরতা চালিয়ে হিমালয়ান রাজ্য সিকিমকে ভারতীয় ইউনিয়নের ২২তম রাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। ‘র’-এর গোপন মিশন সফল হয় ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে এক বিতর্কিত গণভোট আয়োজনের মধ্য দিয়ে। তবে প্রতিবেশী চীন ওই গণভোট মেনে নেয়নি।
‘সিকিম ডন অব ডেমক্রেসি: দ্য ট্রুথ বিহাইন্ড দ্য মার্যার উইথ ইন্ডিয়া’ শিরোনামের নতুন এক বইয়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে। দেখানো হয়েছে অশান্ত বছরগুলোতে ভারত কিভাবে গোপনে চীন সীমান্তে তার স্বার্থ নিশ্চিত করেছিলো। ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশনায় ‘র’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ওই সময়ের প্রধান রামেশ্বর নাথ কাও বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া ওই অভিযানের বিস্তারিত গ্রাফিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে।
আরো পড়ুনঃ খালেদা ও তারেকবিহীন ‘নতুন বিএনপি’ সৃষ্টি বাংলাদেশে ভারতের গেম প্লান!
বইটি লিখেছেন জি বি এস সিধু। ১৯৭০’র দশকের গোড়ার দিকে সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে তিনি ছিলেন ‘র’-এর স্টেশন চিফ। বইয়ে তিনি হিমালয়ান রাজ্যটিতে ‘র’-এর তিন সদস্যের গোপন টিমের প্রতি সপ্তাহের তৎপরতার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এদের পরিচালিত করতেন কাও এবং ‘র’-এর পূর্বাঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক পি এন ব্যানার্জি।
সিধু বলেন, অভিযানটি এতই গোপনীয় ছিল যে কাও, ব্যানার্জি ও আমিই কেবল জানতাম – এই অভিযানের লক্ষ্য হলো সিকিমকে ভারতের মধ্যে নিয়ে আসা।
দিস উইক ইন এশিয়াকে সিধু বলেন, একটি পর্ব শেষ হলেই কেবল পরবর্তী পর্বের ব্যাপারে গ্যাংটকে ‘র’-এর বিশেষ টিমের আরো দুই সদস্য – পাদম বাহাদুর প্রধান ও মেংমা শেরিংকে ব্রিফ করা হতো।
১৯৭৫ সালে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত সিকিম ছিলো রাজা শাসিত রাজ্য। এটি শাসন করতেন চোগিয়াল (ঈশ্বর রাজা) পালদেন থানদুপ নামগিয়াল। তিনি বৃহত্তর স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। স্পষ্টত এ ক্ষেত্রে তার আমেরিকান দ্বিতীয় স্ত্রী হোপ কুকের প্রভাব ছিলো।
ভারত ১৯৭২ সাল থেকে সিকিমে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের উপর তীক্ষ্ণ নজরদারি শুরু করে। সিধু লিখেন, প্রধানমন্ত্রী গান্ধী সিকিম নিয়ে আলোচনার জন্য কাও ও তার মুখ্যসচিব পিএন হাকসারকে ডেকে পাঠান।
‘তিনি বলেন যে চগিয়াল খুব কঠিন হবে। তার রাজ্যটিকে পূর্ণ সার্বভৌম অধিকার দিলেই কেবল তিনি ভারতের সঙ্গে স্থায়ী এসোসিয়েশন গড়তে রাজি হবেন।’ [ভারত জাতিসংঘ সংস্থাগুলোতে সিকিমের সদস্যপদ স্পন্সর করবে এই আশায়।]
কিন্তু উত্তরের রাজ্যটিতে ভারতের কৌশলগত স্বার্থ থাকায় সেটিকে পূর্ণ সার্বভৌম অধিকার দিতে ভারত রাজি ছিলো না। তাই সিকিমের ব্যাপারে কিছু করতে ‘র’-কে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে সিকিমের নেতার কাছে ভারত শেষ বারের মতো প্রস্তাব দেয়। সিধু বলেন, সেখানে চগিয়ালের ব্যাপারে ভারতের নীতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়।
চগিয়ালের শাসনের অবসান ঘটিয়ে সিকিমকে ভারতীয় ইউনিয়নের মধ্যে নিয়ে আসার গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ১৯৭৩ সালে সিধু গ্যাংটকে পোস্টিং পান।
সিধু লিখেন কিভাবে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচারণা জোরদার করার জন্য সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এসএনসি) মতো গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা হয় এবং কিভাবে এসব দলকে ‘র’ কর্মকর্তারা গোপনে পররামর্শ দিয়ে যান, যদিও ভারতের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে তাদেরকে কিছু জানানো হতো না।
সিধু বলেন, আমরা শুধু এসএনসি প্রধান কাজি লেন্দুপ দর্জিকে আস্থায় নিয়েছিলাম কারণ আমাদের বিশ্বাস ছিলো তিনি বিশ্বাসভঙ্গ করবেন না। অন্য রাজনীতিক, যাদের বেশিরভাগ চগিয়ালের প্রতি সহানুভুতিশীল ছিলেন তাদেরকে আস্থায় আনা হয় ধীরে ধীরে।
সিধু বলেন, চগিয়ালকে দুর্বল করে ফেলার জন্য ভারত রাজনৈতিক দলগুলোর রাজতন্ত্র বিরোধী প্রচারণার গতিকে কাজে লাগায়। রাজ্য সংসদ পর্যাপ্ত ক্ষমতা অর্জন না করা পর্যন্ত এটা চলতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত রাজ্য প্রশাসনের ভার নেয় ভারতের কর্মকর্তারা।
সিধু লিখেন, ১৯৭৩ সালের জুলাইয়ে আমরা সিকিমে চগিয়াল বিরোধী ও গণতন্ত্রপন্থী রাজণৈতিক দল ও সেগুলোর নেতাদের, বিশেষ করে কাজি লেন্দুপ দর্জিকে সমর্থন প্রদানের কাজটি শুরু করি। তারা যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার চাচ্ছিল তাকে আমরা সমর্থন করি। এই অপারেশন শেষ হয় সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে। শেষ লক্ষ্যটি অর্জিত হয় মঞ্চে এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায়। যতদূর সম্ভব নির্বাচিত নেতাদের প্রতি জনগণের সমর্থন আদায়ের মধ্য দিয়ে এটা করা হয়।
নেপাল, ভুটান, চীন ও ভারতের মাঝে অবস্থিত সিকিমকে নিয়ে বহু দশক ধরে ভূখণ্ডগত বিরোধ চলছিলো।
যদিও ১৯৭৫ সালে গণভোটের মধ্য দিয়ে ওই এলাকার উপর চীনের দাবি খর্ব হয় কিন্তু আশপাশের এলাকা নিয়ে কূটনৈতিক বিরোধ অব্যাহত থাকে।
সিধু জানান যে ভারতের সঙ্গে মিশে যেতে রাজ্যসভা চূড়ান্ত প্রস্তাব গ্রহণের আগ মুহূর্তে ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী রাজতন্ত্রপন্থী সিকিম গার্ডকে নিরস্ত্র করে।
এর কারণ ছিলো, তিনি বলেন, আমাদেরকে বলা হয়েছিলো যে তারা প্রস্তাব গ্রহণে বাধ সাধতে পারে, এমনকি চগিয়ালের নির্দেশে কয়েকজন গণতন্ত্রপন্থী নেতাকে হত্যাও করতে পারে।
নাথু লা সীমান্তে ভারতীয় রক্ষীর সঙ্গে কথা বলছে এক চীনা সীমান্ত রক্ষী, ছবি: এএফপি
সিধু দাবি করেন যে সিকিম অপারেশনে শক্তির অনুপস্থিতি ছিলো – ছোট রাজ্যকে কোন বড় রাজ্য দখলের ক্ষেত্রে যেমনটা দেখা যায়।
সিধু বলেন, তাই কেউ কেউ যেভাবে একে সংযুক্তকরণ বলছেন তা ন্যায্য নয়। আমরা শুধু আমাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য জণগণের জনপ্রিয় অনুভুতিকে কাজে লাগিয়েছি। এটা ছিলো রাজনৈতিক অপারেশন। এখানে তেমন কোন সামরিক অপারেশন চালানো হয়নি।
সিধুর বইয়ের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে সাবেক ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা সুবীর দত্ত বলেন: ভারতীয় গোয়েন্দা অপারেশগুলোর মধ্যে সিকিম অন্তর্ভুক্ত করার মতো সফলতা খুব কমই দেখা যায়।
তিনি বলেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল বৈরিতার মুখে ওই একীভূত করার লক্ষ্যটি অর্জিত হয়েছিলো। এই দুই দেশই ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছিলো। তাই সিকিম অপারেশনটি ছিলো বিশেষ ধরনের। কারণ এটা ছিলো গোপনীয় এবং বড় ধরনের কোন আন্তর্জাতিক হৈচৈ ছাড়াই লক্ষ্যটি অর্জিত হয়েছিলো। সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন