লবণ আমদানিতে ক্ষুন্ন উৎপাদকের স্বার্থ
নিজস্ব প্রতিবেদক: মূলত ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সরকার যে কোনো পণ্য আমদানি কিংবা রপ্তানি করে থাকে। যখন দেশীয়ভাবে পণ্য উৎপাদনে ঘাটতি হয়, তখন সরবরাহ কমে আসায় সে পণ্যের মূল্য বাড়ে। তখন সরকার ভোক্তার স্বার্থে সে পণ্য আমদানি করে। আর অর্থনীতির সূত্রই হচ্ছে, পণ্যের সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে, আবার সরবরাহ বাড়লে দাম কমে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশে বছরে লবণের চাহিদা প্রায় ১৮ লাখ ৫০ হাজার টন, যা দেশীয়ভাবে উৎপাদিত লবণ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব। অথচ সুযোগসন্ধানী কিছু অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ১১ লাখ টন লবণ আমদানির চেষ্টা চালাচ্ছে। এ অবস্থায় লবণ যদি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, তাহলে দেশের লবণচাষিরা বিপাকে পড়বেন, এটাই স্বাভাবিক।
মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধানে জানা গেছে, লবণচাষিরা অপরিশোধিত লবণ চাষ করে। পরে অপরিশোধিত লবণ পরিশোধনের পর ভোক্তা পর্যায়ে বিপণন করা হয়। চাহিদার বাড়তি লবণ আমদানি করা হলে লবণের বাজার দর যেমন একদিকে আরো কমে আসবে, অন্যদিকে পরিশোধিত বিদেশি লবণের কারণে দেশীয় লবণের মূল্যও কমে আসবে। ফলে লবণচাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পণ্যের সরবরাহ বাড়লে দাম কমে আসে। লবণ আমদানির অনুমতি দিলে তা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। যদিও সরকারিভাবে লবণ আমদানি বন্ধ রয়েছে। তবে দেশীয় লবণচাষি এবং লবণ পরিশোধন শিল্পকে বাঁচাতে হলে বেসরকারিভাবে লবণ আমদানির অনুমতি দেওয়া কোনোভাবেই সমীচীন হবে না।
তাদের মতে, এমনিতেই আমাদের দেশে অধিকাংশ সময়েই উৎপাদকের স্বার্থ রক্ষা হয় না। একটু বাড়তি উৎপাদন হলেই দরপতন ঘটে। ফলে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ঘটনা শুধু লবণ উৎপাদনের ক্ষেত্রেই নয় বরং ধান, সবজি থেকে শুরু করে প্রতিটি কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। গত কয়েক বছর ধরে ধানচাষিরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যদিও এ বছর আমন মৌসুমে সরকার কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে মিলারদের কাছ থেকে চাল কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে ধান কেনার পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে। এবার আমন মৌসুমে ৬ লাখ টন ধান কৃষকের কাছ থেকে কেনার উদ্যোগ নেওয়ার পরও ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও বরাদ্দকৃত ধানের সিংহভাগ এখনো কেনা সম্ভব হয়নি। হয়তো শেষ পর্যন্ত কৃষকের পুরো ধান কেনা হলে শেষ পর্যায়ে ধানের মূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু তখন প্রান্তিক চাষিদের কাছে আর ধান থাকবে না। ধান চাল যাবে মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের হাতে। ফলে ভোক্তাদের চড়া দামে চাল কিনে খেতে হবে। এই হচ্ছে বাস্তবতা।
মিল মালিক ও লবণচাষিরা বলেন, একটি অসৎ ও অতি মুনাফালোভী লবণ সিন্ডিকেটের কারণে দেশে লবণের বাজার অস্থিতিশীল। সঠিক দাম পান না লবণচাষিরা। লবণ শিল্পবিরোধী চিহ্নিত চক্রকে দমন করতে না পারলে আগামী দিনে লবণ শিল্পখাতকে আরো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। তাদের অভিযোগ প্রতিদিনই ফিনিশ লবণ দেশে ঢুকছে, যা কম দামে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। উল্লেখ্য, উৎপাদিত দেশীয় লবণ উদ্বৃত্ত থাকার পরও প্রতিবছরই কম-বেশি লবণ আমদানি করা হচ্ছে। ট্যাক্স ফ্রি সোডিয়াম সালফেট ছড়িয়ে দিচ্ছে বাজারে। নানা কৌশলে যেভাবে লবণ আমদানি করা হচ্ছে তা বন্ধ করে লবণচাষিদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। যার কোনো বিকল্প নেই।
ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, লবণ আমদানি করা হবে না। এক মাননীয় সাংসদ জানিয়েছেন, যদিও লবণ আমদানি বন্ধ রয়েছে, তবু ব্যাক টু ব্যাক এলসির নামে যারা লবণ আমদানি করছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত ওই সভায় জেলা আওয়ামী লীগের একজন রাজনীতিকও বলেছেন, আমরা রাজনীতি করি মানুষের জন্য। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লবণচাষিরা দাম না পাওয়ায় আন্দোলন করছেন। যদি লবণচাষিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে সেটা হবে আমাদের ব্যর্থতা।
লবণ মিল মালিক ও চাষিদের ওই সভায় কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী প্রস্তাব করেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে স্থানীয় মিল থেকে সরাসরি লবণ সরবরাহ করা সম্ভব হলে বর্তমান সংকট অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হবে। যদিও এ প্রস্তাবে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। তবে সবাই চান লবণচাষিদের লবণের মূল্য নিশ্চিত করতে; কিন্তু বাস্তবে যা নিশ্চিত করাও অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। এ কারণে সরকারের কৃষি বিভাগ থেকে প্রতিবছরই কোন পণ্য কী পরিমাণ চাষ করা দরকার, তা ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রচারণা চালানো উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে কৃষি বিভাগ কিংবা কোনো সরকারি দপ্তরই এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে না। ফলে অনুমাননির্ভর কিংবা অপরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ করায় অধিকাংশ সময়ই চাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন