মিয়ানমার সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম, জাতিসংঘের তদন্ত আহ্বান
সাস নিউজ২৪ ডট কম ডেস্ক : মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের গ্রামের পর গ্রাম। গত ৯ই অক্টোবর থেকে ২৩শে নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে কমপক্ষে ১৫০০ বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে সেনারা। অথচ সরকার এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে বাড়িঘরে আগুন দেয়ার জন্য দায়ী করছে রোহিঙ্গা কট্টরপন্থিদের। এ অবস্থায় সেখানকার মংডুর সব এলাকায় মানবিক সহায়তা বিষয়ক সংস্থা, মিডিয়া ও মানবাধিকার বিষয়ক পর্যবেক্ষকদের অবিলম্বে প্রবেশাধিকার দেয়া উচিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাদের। ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য জাতিসংঘকে আমন্ত্রণ করা উচিত। ১৩ই ডিসেম্বর মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক রিপোর্টে এসব কথা বলেছে। এতে বলা হয়েছে, স্যাটেলাইটের ছবি ও শরণার্থীদের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে তারা নিশ্চিত হতে পেরেছে যে, বিপুল পরিমাণ বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে সেনারা। এতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাড়িছাড়া হয়েছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্রাড এডামস বলেছেন, মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনী গ্রামে অগ্নিসংযোগের দায় রোহিঙ্গা কট্টরপন্থিদের ওপর দিলেও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যে নতুন তথ্য পেয়েছে তা সরকার ও সেনাবাহিনীর দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে। বাড়িঘর যে সেনাবাহিনী আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে তার দিকে পরিষ্কারভাবে আঙ্গুল তোলে স্যাটেলাইটে পাওয়া ছবি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাতকার। মংডু টাউনশিপের গ্রামগুলোর নতুন স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে চারটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া যায়।
এক. ২৩শে নভেম্বর পর্যন্ত মোট ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে ১৫০০ বাড়িঘর। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে। কারণ, গাছপালার জন্য ধ্বংস করে দেয়া সব বাড়িঘরের ছবি স্যাটেলাইটে স্পষ্ট বোঝা যায় না।
দুই. বাড়িঘর যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে তাতে বোঝা যায় এর জন্য দায়ী সরকার। ৯ই অক্টোবর থেকে ১৪ই অক্টোবরের মধ্যে প্রথমে পুড়িয়ে দেয়া হয় তিনটি গ্রাম। এগুলো তুং পাইও জেলার প্রধান সড়কের পাশে। ১২ থেকে ১৫ই নভেম্বরের মধ্যে দ্বিতীয় দফা আগুন দেয়া হয় গ্রামে। এটাই বৃহৎ আকারে অগ্নিসংযোগ। এ ঘটনা ঘটে ওই সড়কের ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে।
তিন. রোহিঙ্গা কট্টরপন্থিদের হামলার পর তিন দফায় গ্রামে ধ্বংসলীলা চালানো হয়। পর্যায়ক্রমিকভাবে এ ঘটনা প্রামাণ্য হিসেবে ধারণ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা কট্টরপন্থিদের হামলার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই অগ্নিসংযোগ করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অগ্নিসংযোগ করা হয় একদিন বা দু’দিন পরে। ১২ই নভেম্বর সকালে পিন্ট হ্পিউ চাউং এলাকায় সীমান্ত টহলের দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর য্যেথ দলের ওপর হামলার পর ওই গ্রামের কমপক্ষে ৮০০ ভবন বা বাড়িঘর পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়। পরের চারদিনে পুড়িয়ে দেয়া হয় অন্য ৫টি বাড়ি।
চার. স্যাটেলাইটের ছবিতে বর্ডার গার্ড পোস্ট নাম্বার ‘-এ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখা যায়। এ স্থানটি ওয়া পেইক গ্রামের সঙ্গে যুক্ত। এ গ্রামটি পুড়োপুড়ি পুড়িয়ে শেষ করে দেয়া হয়েছে। এক মাসের মধ্যে তিন দফায় এ গ্রামে হামলা চালানো হয়। সেনাবাহিনীর ওই পোস্ট ও সেনাবাহিনীর অন্য দুটি অবস্থানস্থলে গত ৯ই অক্টোবর কথিত কট্টরপন্থিরা হামলা চালায়। এতে নিহত হয় ৯ সেনা সদস্য। এর ফলেই গত প্রায় দু’মাসের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে রাখাইনে।
ওই হামলার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ওয়া পেইক গ্রামে প্রথম অগ্নিসংযোগ করা হয় ৯ই অক্টোবর বিকালে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তখন সেখানে সেনাবাহিনীর বহুবিধ পরিবহন যানের উপস্থিতি দেখতে পেয়েছে। একই সঙ্গে সেখানে পর্যায়ক্রমে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার অবতরণ চিহ্নিত করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। ব্রাড এডামস বলেন, ওই গ্রামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী উপস্থিত থাকা অবস্থায় এক মাস সময়ের মধ্যে কট্টরপন্থিরা ওয়া পেইক গ্রামের কমপক্ষে ৩০০ বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, এটা বিশ্বাস করা দুরূহ। সেনাবাহিনী এভাবে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া দেখেছে এটাও বিশ্বাস করা কঠিন। তাই এই স্যাটেলাইটের ছবি দিয়ে মিয়ানমার সরকারের কর্মকর্তাদের কথা আস্থায় নেয়া যায় না। এখন সময় এসেছে তাদের কথায় বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকায় প্রত্যাখ্যানের অবস্থান থেকে সরে এসে বাস্তবতা মেনে নেয়া।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও বলেছে, যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থী পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন তারা যে বর্ণনা দিয়েছেন সেনাবাহিনীর অগ্নিসংযোগের বিষয়ে তা আরও নির্মম। এ বিষয়ে ১০ জন শরণার্থীর সাক্ষাতকার নিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কিভাবে বাড়িঘর ধ্বংস করে দিচ্ছে, আগুনে মানুষ পুড়িয়ে মারছে তার বর্ণনা দিয়েছেন। তারা বলেছেন এভাবে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে কায়েত ইয়ো পাইন, দার গাই জার, ইয়ে খাত চাউং গওয়া সান গ্রাম। কায়েত ইয়ো পাইন গ্রামের বাসিন্দা আবদুল (২৩)। তিনি বলেছেন, ১২ই অক্টোবর তার গ্রামের দিকে অগ্রসর হয় সেনাবাহিনী। তারা গ্রামে প্রবেশ করেই গ্রামবাসীর ওপর গুলি করা শুরু করে। গ্যাসোলিন ও রকেট লঞ্চার দিয়ে গ্রামে হামলা চালানো হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় গ্রাম। এ সময় আবদুল গ্রাম ছেড়ে পালান। আরেক রোহিঙ্গা চোমি (৩৫)। তিনি বলেছেন, আমার গ্রাম দার গাই জার। ১৩ই নভেম্বর আমার গ্রামে প্রবেশ করতে দেখি সেনাবাহিনীকে। তারা বাড়িঘরে রকেট লঞ্চার দিয়ে আক্রমণ করে। এতে বাড়িতে আগুন ধরে যায়। পাশের মাঠের ভিতর দাঁড়িয়ে আমি দেখতে পাই গ্রাম জ্বলছে। তারপর আমি স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে ওই এলাকা থেকে পালাই। চলে আসি বাংলাদেশে। ইয়ে খাত চাউং গওয়া সান গ্রামের বাসিন্দা আহমেদ (৪৫)। তিনি বলেছেন, মধ্য নভেম্বরে সেনাবাহিনী প্রবেশ করে তার গ্রামে। তারপর ঘরের চালে বা ছাদে গ্যাসোলিনের জার ছুড়ে মারে। এরপর একের পর এক ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওদিকে ১৬ই নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলন করে মিয়ানমার সরকার। এতে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন ছবি প্রদর্শন করা হয়। ওই ছবিগুলো ধারণ করেছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এগুলো হেলিকপ্টার থেকে ধারণ করে তারা। এ ছবি দেখিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করে দেয়ার যে অভিযোগ এর আগে উত্থাপন করেছিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তা প্রত্যাখ্যান করে সরকার। কিন্তু সরকার ওই সময় কায়েত ইয়ো পাইন, দার গাই জার, ইয়ে খাত চাউং গওয়া সান গ্রামে অগ্নিকা-ে যেসব বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়েছৈ তা দেখায় নি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দার গাই জার গ্রামের ধ্বংসলীলার রিপোর্ট করেছে বলে মিয়ানমার সরকার সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করে। কিন্তু এটা সরকারের ভুল। কারণ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার প্রথম রিপোর্টে ওই গ্রামের নাম উল্লেখ করে নি। কারণ, ওই সময়ে ওই গ্রামে ধ্বংসলীলা চালানো হয় নি। সরকার দাবি করেছে এই গ্রামে ৩০টি ভবন বা বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু স্যাটেলাইটের ছবিতে দেখা যায় এ সংখ্যা আড়াই শতাধিক। এ গ্রামসহ আশপাশের যেসব গ্রামে ধ্বংসলীলার ছবি দেখায় নি সরকার। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করা হেলিকপ্টার থেকে তোলা ছবি ক্যামেরায় ধারণ করার আগেই ওই গ্রামগুলোতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। অধিকন্তু ১৫ই নভেম্বর বিকালে ইয়ে খাত চাউং গওয়া সান গ্রামে অনেকগুলো বাড়িতে আগুন জ্বলতে দেখা যায়।
৯ই অক্টোবর থেকে রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর চলমান অভিযানের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে জনসাধারণের ওপর। প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। কিন্তু অভাবী এসব মানুষের প্রয়োজন মেটাতে বা তাদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপনে মানবিক সংস্থাগুলোকে ওই এলাকায় প্রবেশ করতে দিচ্ছে না সেনাবাহিনী ও সরকার। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন বলেছে, প্রায় ২১ হাজার মানুষ পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। জাতিসংঘ ও অন্যরা দাবি যেমনটা দাবি জানিয়েছে, তেমনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচও বলেছে, রাখাইন রাজ্যের সব অংশে অবিলম্বে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে অনুমতি দেয়া উচিত সরকারের। জরুরিভিত্তিতে যাতে এই সুবিধা দেয়া হয় এজন্য সেনাবাহিনী ও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত বিভিন্ন দেশের সরকারের।
১লা ডিসেম্বর মিয়ানমার সরকার রাখাইনের ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। ওই কমিটির রিপোর্ট দেয়ার কথা ৩১শে জানুয়ারির মধ্যে। কিন্তু ওই কমিটিতে যাদেরকে রাখা হবে তাদের ম্যান্ডেট নিয়ে মারাত্মক সংশয় দেখা দিয়েছে। রাখাইনে বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড, যৌন সহিংসতা সহ যেসব নির্যাতনের কথা বলা হচ্ছে তার পূর্ণাঙ্গ ও পক্ষপাতহীন তদন্ত এ কমিটি করতে পারবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অক্টোবরে রাখাইন রাজ্যের পার্লামেন্টও পরিস্থিতি পরীক্ষা করে দেখতে একটি কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু ওই কমিশনে যেসব সদস্য রয়েছেন তাদের অনেকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমুলক মন্তব্য করেছেন। ফলে এ কমিটির বিশ্বাসযোগ্যতা ও বস্তুনিষ্ঠতা নিয়েও সংশয় আছে। এই কমিশনও সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের বিষয়টি তদন্ত করতে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এর পরিবর্তে সরকারের উচিত পক্ষপাতহীন তদন্তের জন্য জাতিসংঘকে আমন্ত্রণ জানানো।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন