ভয়াবহ দূষণে হাতিরঝিলের পানি
নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর হাতিরঝিলের পানি মাত্রাতিরিক্ত দূষিত হয়ে পড়েছে। দূষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। এ অবস্থায় ঝিলের পানি শোধন ও দুর্গন্ধমুক্ত করতে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। তবে এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ এক দফায় এক বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে।
রাজউক সূত্র জানিয়েছে, হাতিরঝিল লেকের পানির দুর্গন্ধ দূর করতে ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ৪৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ওই বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত। পরে আরও এক বছরের জন্য প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বলা হয়েছে, এটি বাস্তবায়িত হলে হাতিরঝিলের পানি দুর্গন্ধ ও দূষণমুক্ত হবে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ৪০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি রাজউকের।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর এর পানির মান ফেরানো যাচ্ছিল না। এর আশপাশের বাসাবাড়ির বর্জ্য ঝিলে পড়ার কারণে পানি দূষিত হয়ে পড়ে। এ থেকে প্রতিনিয়ত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এ অবস্থায় লেকের বিভিন্ন স্থান থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে পাওয়া হাতিরঝিল দূষণের অন্যতম কারণ উল্লেখ করে প্রকল্পের নথিপত্রে বলা হয়েছে, হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের লেক একটি স্টর্ম ওয়াটার রিটেনশন বেসিন হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু লেকের নালা এলাকায় স্টর্ম ও স্যুয়ারেজ লাইন আলাদা ছিল না। ফলে বর্জ্য মিশ্রিত পানি হাতিরঝিল লেকে পড়ছে। বর্ষাকালে অতি বৃষ্টির সময় লেকের সব নালা বা পথ খুলে দেওয়া হয়। ফলে পয়োবর্জ্য সরাসরি ঝিলের লেকে পড়ে। এর ফলে পানি দিন দিন দূষিত হচ্ছে। ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ।
সরেজমিন দেখা গেছে, হাতিরঝিলের পানি কালো হয়ে পড়েছে। এর বিভিন্ন অংশে ময়লা আবর্জনা পড়ে রয়েছে। ঝিলের মধ্যে ৯টি মেকানিক্যাল স্ক্যানার রয়েছে। এর মাধ্যমে ঝিলের আশপাশের এলাকার বাসাবাড়ি ও বৃষ্টির পানি ঢাকা ওয়াসার ড্রেনের মাধ্যমে হাতিরঝিলে অপসারিত হয়। কিন্তু নগরজুড়ে ৫০ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টি কিংবা টানা বর্ষণ হলে এই স্ক্যানারগুলো পানির চাপ সামলাতে পারে না। তখন সব খুলে দেওয়া হয়। ফলে বর্জ্য দুর্গন্ধ ছড়ায়।
এদিকে হাতিরঝিল নিয়ে ‘মিস প্ল্যান’ হয়েছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন খোদ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, হাতিরঝিল নিয়ে মিস প্ল্যান হয়েছে। বর্তমানে ডিএনসিসি এলাকায় মগবাজার প্রধান সড়ক, জাহান বক্স লেন, শাহ সাহেব বাড়ি লেন, নয়াটোলা ও মধুবাগ এলাকায় পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। হাতিরঝিল করার সময় যদি এই এলাকাগুলো নিয়ে পরিকল্পনা করা হতো, তাহলে এই সমস্যাটা হতো না। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীসহ হাতিরঝিল এলাকা পরিদর্শন করেছি। টিসিবি ভবনের সামনে পানি জমে। অথচ তার পাশেই হাতিরঝিল। এসব বিষয় নিয়ে এখন আমাদের প্ল্যান করতে হচ্ছে।
মেয়র আরও বলেন, এখন হাতিরঝিল প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতকে মাথায় রেখে এর প্ল্যান করা হয়েছে। বাংলাদেশ তো বৃষ্টিপ্রবণ দেশ। ৬ ঋতুকে মাথায় রেখেই প্ল্যানটি করা উচিত ছিল। ৫০ থেকে ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে ঢাকার অবস্থা কী হবে সেটাও ভাবার দরকার ছিল। এখন হাতিরঝিলে আরও বেশি পাম্প বসিয়ে পানি আউট করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি হোক শর্ট ওয়েতে পানি নিষ্কাশন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, হাতিরঝিলের পানি নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে- কাওরান বাজার, পান্থপথ, ধানমন্ডি, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান ও বাংলামোটরসহ এই এলাকার বর্জ্য সোনারগাঁও হোটেলের পেছনের অংশ দিয়ে হাতিরঝিলে পড়ে। এটা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। এখন আমরা চাচ্ছি কেমিক্যাল দিয়ে পানির স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আনা। প্রতিবছর এই কেমিক্যাল ব্যবহার করতে হবে। না হলে আবার আগের মতো হয়ে যাবে।
হাতিরঝিল প্রকল্পটি ২০০৭ সালের অক্টোবরে একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। ৩ বছর মেয়াদের এ প্রকল্পটি প্রথমে ২০১০ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এর কাজই শুরু হয় ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে। পরে প্রকল্পটি সংশোধন করে আরও দেড় বছর সময় ও বরাদ্দ বাড়ানো হয়। প্রকল্প ব্যয় এক হাজার ৯৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকার মধ্যে বাস্তবায়নকারী সংস্থা রাজউকের এক হাজার ১১৩ কোটি ৭ লাখ, এলজিইডির ২৭৬ কোটি এবং ঢাকা ওয়াসার ৮৬ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা রয়েছে। ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাতিরঝিল প্রকল্পের উদ্বোধন ও জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করেন। এটি বাস্তবায়ন ও তদারকি করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অরগানাইজেশন (এসডব্লিউও)।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন