ব্যাংকের অর্থ ঋণখেলাপি মাফিয়াদের হাতে
নিজস্ব প্রতিবেদক: কয়েক বছর ধরেই ব্যাংকিং খাতে চলছে টালমাটাল অবস্থা। নিরাপদ তারল্য ধরে রাখা এ সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা। সচেতন মহলবিশেষে আলোচনার খোরাকও এটি। নগদ অর্থপ্রবাহে ঘাটতি থাকলে ব্যাংকে তারল্যসংকট তৈরি হয়।
এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহক ব্যাংকে তার চাহিদা মতো বাধাহীন টাকা তুলতে পারে না। উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় ঋণ পান না। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি কমে যায়। শিল্পে বিনিয়োগও এতে হ্রাস পায়। যদিও এর উল্টো ঘটনার নজিরও তৈরি হচ্ছে অহরহ। ব্যাংকে যে পরিমাণ মূলধন আমানত রয়েছে, ঋণ দেয়া হচ্ছে তার থেকে বেশি।
এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) সীমাও অতিক্রম করে যাচ্ছে অনেক ব্যাংক। ফলে তাদের তারল্য পরিস্থিতি বা নগদ অর্থ কমে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে উচ্চ সুদে কল মানির মাধ্যমে অন্য ব্যাংক থেকে নগদ অর্থ ধার করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নিয়মবহির্ভূত আগ্রাসী ব্যাংকিংই এর অন্যতম কারণ।
প্রশ্ন উঠছে যাচ্ছে কোথায় ব্যাংকের টাকা? এদিকে ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটে ভুগলেও মূলধন আমানত বাড়ছে বছর বছর। আবার সঞ্চিত আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণও বাড়ছে অনেক বেশি। তাহলে ওই ঋণ যাচ্ছে কাদের হাতে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকিং খাতে সৃষ্ট তারল্যসংকটের নেপথ্যের শীর্ষে রয়েছে ঋণের বেশিরভাগ অর্থ মাফিয়াদের হাতে চলে যাওয়া। তারা ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অর্থাৎ ম্যানেজ ফর্মুলায় অধিক হারে ঋণ নিয়েছে। কিন্তু তা আর সময় মতো পরিশোধ করছে না। আবার পুরানো ঋণ পরিশোধ না করেই নতুন করে আবারো ঋণ নিচ্ছে।
আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছেআমদানি-রপ্তানির নামে একশ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ী আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকাপাচার করছে।
এক্ষেত্রে অনেকে অভিনব পন্থায় শেল ব্যাংকের মাধ্যমেও টাকাপাচার করছে। যেখানে ব্যাংকে গ্রাহকের নাম-ঠিকানা কিছুই থাকছে না। শুধু একটি কোড নম্বরের ভিত্তিতে হিসাব খুলে আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে এ টাকাপাচার করেছে।
অন্যদিকে ব্যাংকগুলো বেশি লাভের আশায় উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের চেয়ে অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ দেয়ার প্রবণতা বাড়িয়েছে। এই ঋণ ব্যক্তির ভোগ-বিলাসে ব্যবহার হওয়ায় তা পরিশোধ কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে কালো টাকার দাপট বেড়েছে। অর্থনীতির আকার ২৬ লাখ কোটি টাকার বেশি হলেও ব্যাংকব্যবস্থার আওতায় রয়েছে তার অর্ধেকেরও কম অর্থ।
এর বাইরে অপ্রদর্শিত অর্থ অনেকে নিরাপত্তার কারণে ব্যাংকে রাখার পরিবর্তে গোপন রাখতেই পছন্দ করে বেশি। সম্প্রতি ক্যাসিনোকা-ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বাসা-বাড়িতে, ক্লাবে-অফিসে সিন্দুকভর্তি বা বস্তাভর্তি টাকা উদ্ধারের ঘটনা তারই ইঙ্গিত দেয়।
আবার সুশাসনের অভাবে ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। শুধু কাগজে ডকুমেন্ট দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, বড় কয়েকটি ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ফলে ব্যাংকিং খাতের ওপর সাধারণের আস্থা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ফলে তারা সঞ্চিত অর্থ আগের মতো আর ব্যাংকে রাখার আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এর পরিবর্তে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছে। এতে আমানতের পরিমাণ কমে গেছে। আমানত কমে যাওয়ায় ব্যাংকের রক্ষিত টাকা থেকে ঋণ কার্যক্রমও বাড়িয়েছে।
এতে আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়ে ভয়াবহরকম বেড়েছে। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতাও অধিকহারে বেড়েছে। চলতি বছর সরকারের ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৪৭ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, টাকাপাচার হচ্ছে বলেই ব্যাংকে টাকার পরিমাণ কমছে। তার মতে, শুধু ব্যাংক খাতের মধ্য দিয়েই প্রতিবছর প্রায় ৪০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন