বেসরকারি খাতে ঋণ পরিস্থিতির আরও অবনতি
নিজস্ব প্রতিবেদক: বেসরকারি খাতে ঋণ পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। একক মাস হিসেবে নভেম্বরের তুলনায় গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে.৪ শতাংশ। গত নভেম্বর মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯.৮৭ শতাংশ। ডিসেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯.৮৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, বেসরকারি খাতে এতো কম প্রবৃদ্ধি গত ১৫ বছরের মধ্যে হয়নি। এমনকি বিএনপি-জামাতের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের সময়ও (২০১৩-১৪ সাল) বেসরকারি খাতে এত কম ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল না। এ দুই সালে যা ছিল যথাক্রমে ১০.৮০ শতাংশ এবং ১২.০৩ শতাংশ।
আগামীতে বেসরকারি খাতে ঋণের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি থেকে আমানতকারীদের অনেকেই হয়তো ব্যাংকে টাকা রাখবে না। কারণ ফেব্রুয়ারি থেকে আমানতের সুদ হার অর্ধেকে নেমে আসবে। সুদ কমে যাওয়াকে কেন্দ্র করে আমানত না পেলে ব্যাংকগুলোও উদ্যোক্তদের ঋণ দিতে পারবে না। অচিরেই ব্যাংকগুলোতে টাকার সংকট ভয়াবহ রূপ নেবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতে। এই খাতের উদ্যোক্তাদের কোনও ব্যাংকই ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেবে না। এছাড়া আগামী মাসগুলোয় সরকারের ঋণ নেওয়া বেড়ে যাবে। ফলে ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও কমে আসবে।
ব্যাংকগুলোর এমডিরাও বলছে, ব্যাংকের আমানত কমে গেলে তারা ঋণ দিতে পারবেন না। বিষয়টি নির্ভর করছে আমানত পাওয়া-না পাওয়ার ওপর। এ প্রসঙ্গে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আগামী দুই মাস ব্যাংক খাতের জন্য কঠিন পরীক্ষা। এই দুই মাস যদি ৬ শতাংশ সুদে চাহিদামতো আমানত পাওয়া যায়, তাহলে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়বে। আর যদি ব্যাংকে আমানত কমে যায় তাহলে ঋণেও এর প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত ডিসেম্বর মাস শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৫৩ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। গত জুন মাস শেষে এই খাতে ঋণের স্থিতি ছিল ১০ লাখ ১০ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ছয় মাসে ৪২ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে বেসরকারি খাতে ঋণের হার কমছে। গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯.৮৩ শতাংশ। নভেম্বর ছিল ৯.৮৭ শতাংশ। অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.০৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ছিল ১০.৬৬ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১০.৬৮ শতাংশ। যদিও ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৬.৫৫ শতাংশ। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৬.৬৫ শতাংশ। ২০১১ সালে মার্চে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ২৯.১৩ শতাংশে ওঠে।
অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য বলছে, এর আগে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে নেমেছিল। ২০০৫ সালে এটি বেড়ে ১২ শতাংশে উন্নীত হয়। এরপর একক মাস হিসেবে কখনও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি সিঙ্গেল ডিজিট নামেনি।
এমন পরিস্থিতির জন্য খেলাপি ঋণের সংস্কৃতিকে দায়ী করলেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে নানামুখি সংকট তৈরি হয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়াতে ঋণে সুদের হারও বেড়ে গেছে। আর সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় প্রকৃত উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে আগ্রহী হচ্ছে না। বেসরকারি খাতে নেতিবাচক ঋণ প্রবৃদ্ধিই তার প্রমাণ।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের শুরুতে ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে আনতে ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কিছুটা কমিয়ে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে। কয়েক দফা এডিআর সমন্বয়ের সীমা বাড়ানো হলেও ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে না। নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত আছে।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন