প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: বদলি ‘আগ্রাসনে’ বাড়ছে বঞ্চনা
কিশোরগঞ্জ সংবাদদাতা: সাধারণত যার যার স্থায়ী ঠিকানায় নিয়োগ পেয়ে থাকেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। আর এ পদে নারীরা নিয়োগ পান স্বামী বা বাবার স্থায়ী ঠিকানায়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিধিতে শিক্ষকদের স্বামী বা স্ত্রীর কর্মস্থলে বদলির নিয়ম রয়েছে।
এর বাইরে ‘জনস্বার্থে’ আরও শতকরা ২০ ভাগ বদলির সুযোগ আছে। তবে প্রাথমিকে শিক্ষক বদলি ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক ‘অপব্যবহারের’ অভিযোগ পাওয়া গেছে। এটাকে বদলি ‘আগ্রাসন’ বলছেন কেউ কেউ।
জানা গেছে, অস্বাভাবিক হারে বদলির কারণে শূন্যপদ না থাকায় কিশোরগঞ্জ সদর, করিমগঞ্জ, তাড়াইল ও ভৈরব এ চারটি উপজেলার চাকরি প্রত্যাশীতরা এবার প্রাথমিক শিক্ষক পদে চাকরি পাচ্ছেন না। এমনকি আগামী কয়েক বছরেও চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলে জানিয়েছে শিক্ষা অফিসের সূত্রগুলো।
জানা গেছে, এসব উপজেলায় কোনও শিক্ষকের পদ শূন্য হলে (বদলির মাধ্যমে) ‘ঝড়ের বেগে’ তা পূরণ হয়ে যায়। আর এই বদলির পেছনে লাখ লাখ টাকার ‘ঘুষবাণিজ্য’ রয়েছে বলেও শোনা যায়। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও শিক্ষক কেউই এ অভিযোগ স্বীকার করেনা।
বিশেষ করে জেলার হাওর অধ্যুষিত উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের শিক্ষকরা অহরহ বদলি হয়ে ঢুকে যাচ্ছেন উজানের উপজেলাগুলোতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেউ স্বামী বা স্ত্রীর কর্মস্থলে, কেউবা নদী ভাঙনে বাড়িঘর হারানো, কেউ আবার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার অজুহাত দেখিয়ে বদলি হচ্ছেন।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের একটি সূত্র বলছে, বদলির আবেদনে যেসব কাগজপত্র দেওয়া হয়, ওইসব কাগজপত্র অনেক সময়যাচাই করেও দেখা হয় না। এছাড়া, বদলির জন্য সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, বড় কর্মকর্তা এমনকি সর্বোচ্চ ঊর্ধ্বতন জায়গা থেকেও সুপারিশ ও নির্দেশ আসেন বদলি হতে ইচ্ছুকরা। ফলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কিছুই করার থাকে না।
কিশোরগঞ্জ সদরের উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এনামুল হক খান বলেন, আমি তিন বছর ধরে হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামে ছিলাম। সেখানে আমার হাত দিয়ে ৩৯ জন শিক্ষক সদর, ভৈরবসহ বিভিন্ন উপজেলায় বদলি হয়ে গেছেন। বর্তমানে ২০ ভাগ বদলির বিধানে সদরে ৮৮ জন বহিরাগত শিক্ষক রয়েছেন।
আরেকটি সূত্র বলছে, এই ২০ ভাগসহ বৈবাহিক সূত্র মিলিয়ে সদরে অন্তত দেড় থেকে দু’শ জন বদলির শিক্ষক রয়েছেন। তাই এখানে কোনও শূন্যপদ নেই। সদর উপজেলার ১৪২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৯৭১ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা শাখার সভাপতি আসাদুজ্জামান খান ও সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন শাহীন দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, বদলি নিয়মের অপব্যবহারের কারণে সদরসহ উজানের অন্তত চারটি উপজেলার চাকরি প্রত্যাশীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। পরিকল্পিতভাবে শূন্যপদগুলো দখল করে রেখেছে বহিরাগতরা। এটা রীতিমতো আগ্রাসন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শিক্ষক পদে সদরের কেউ চাকরি পাবে না। যদি ওই সময়েও বদলি অব্যাহত থাকে, তাহলে এ বঞ্চনা আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনের সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের নারী শিক্ষকরা বৈবাহিক সূত্রে করিমগঞ্জ ও তাড়াইলের শূন্য পদগুলো দখল করেছেন। ফলে শিক্ষক নিয়োগের সময় স্থানীয়রা চাকরি পাচ্ছেন না। বিষয়টি নিয়ে আমি নিজেও হতাশ। বদলির যে নিয়ম চালু রয়েছে, এটা রদবদল করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
করিমগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি শামসুল হক ফরহাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির যে নিয়মটি চালু রয়েছে, এটি রদবদল না হলে কিশোরগঞ্জ সদর, করিমগঞ্জ, তাড়াইল ও ভৈরবের মতো এলাকাগুলোর চাকরি প্রত্যাশীদের বঞ্চনার অবসান হবে না। বরং দিন দিন এ বঞ্চনা আরও বাড়বে। তিনি বলেন, যেসব উপজেলা থেকে শিক্ষকরা বদলি হয়ে চলে আসছেন, শূন্য পদগুলোতে আবারও চাকরি পাচ্ছেন সেখানকার লোকজনই। আর উজানের লোকজন তো ওইসব এলাকার জন্য আবেদনও করতে পারে না। কারণ, শিক্ষক পদগুলো সংশ্লিষ্ট উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য সংরক্ষিত থাকে।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন