জাফরান চাষে সফল শেকৃবি অধ্যাপক
শেকৃবি সংবাদদাতা: ‘লাল সোনা’ নামে পরিচিত পৃথিবীর দামি মসলা জাফরান সাধারণত উৎপাদিত হয় শীতপ্রধান অঞ্চলে। বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্মম-লীয় এলাকায় জাফরান চাষের প্রচলন কখনোই ছিল না। তবে এবার বাংলাদেশের মাটিতেই জাফরান চাষের দারুণ সম্ভাবনা তৈরি করেছেন ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ ফ ম জামাল উদ্দিন। উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের এই শিক্ষক ও গবেষক আলো-আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কক্ষে জাফরানের ফুল ফোটাতে সক্ষম হয়েছেন। তা থেকে সফলভাবে সংগ্রহ করেছেন লাল রঙের স্টিগমা (গর্ভমু-)। এটাই মূলত জাফরান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এই অধ্যাপকের ভাষ্য, উন্মুক্ত জায়গায় উপযুক্ত পরিবেশেও জাফরান চাষ বেশ ব্যয়বহুল। সে হিসেবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কক্ষে উৎপাদন খরচ আরেকটু বেশিই হওয়ার কথা। কিন্তু এই পদ্ধতিতে আবহাওয়াজনিত কারণে ফসল মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কম। আর বছরে একাধিক বার ফলন ওঠানো যাবে। তাই এই গবেষক মনে করেন, এর সঙ্গে বিশ্বব্যাপী জাফরানের বিপুল চাহিদা ও দামের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া সাপেক্ষে বাংলাদেশেই এর লাভজনক বাণিজ্যিক উৎপাদন সম্ভব।
বিশ্ববাজারে প্রতি গ্রাম জাফরানের দাম চার ডলারের মতো। সে হিসাবে প্রতি কেজি জাফরানের দাম পড়ে তিন লাখ টাকার বেশি।
এই গবেষক জানান, গত বছর জাপান থেকে জাফরানের পাঁচ শতাধিক করম আনান তিনি। প্রথমে সেগুলো ফ্রিজে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রেখে রোপণের উপযোগী করা হয়। পরে তা ঘরের মধ্যে প্লাস্টিক ও টিনের তৈরি ট্রেতে রোপণ করা হয়। দেখা যায়, প্রায় সবগুলো গাছেই ফুল এসেছে। জামাল বলেন, সাধারণত জাফরান চাষে বিস্তীর্ণ জায়গার দরকার হয়। কিন্তু আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি অ্যারোপনিক্স পদ্ধতিতে (বাতাসের মাধ্যমে গাছের খাদ্য উপাদান সরবরাহ) একটা ছোট আকারের ঘরের মধ্যেই এক হেক্টর সমপরিমাণ জায়গার জাফরান উৎপাদন করা সম্ভব। কারণ এই পদ্ধতিতে রোপণ করা গাছের ট্রেগুলো উলম্বভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। জায়গা লাগে কম।
অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের কাছ থেকে জানা যায়, গাঢ় বেগুনি রঙের একেকটি জাফরান ফুল থেকে সাধারণত ৩০ মিলিগ্রাম ওজনের জাফরান পাওয়া যায়। শুকানো অবস্থা যার ওজন দাঁড়ায় সাত মিলিগ্রামে। সে হিসাবে মাত্র এক গ্রাম জাফরান পেতেই অন্তত ১৫০টি ফুলের দরকার হয়। অর্থাৎ এক কেজি সমপরিমাণ জাফরান পেতে দরকার হয় অন্তত দেড় লাখ ফুল। রোপিত করম আকারে বড় ও পুষ্ট হলে প্রথম বছর একটি ও পরবর্তী বছরগুলোতে একেকটি গাছে সাত থেকে আটটি পর্যন্ত ফুল ধরে। অধ্যাপক জামাল বলেন, ইরান কিংবা কাশ্মীরে হেক্টর প্রতি জাফরানের ফলন হয় দুই থেকে আড়াই কেজি। কিন্তু মাত্র ১০০ বর্গফুট আয়তনের কোনো গ্রিন হাউস কিংবা নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার ঘরে বছরে সমপরিমাণ জাফরান উৎপাদন করা যাবে।
বাংলাদেশে জাফরান চাষের প্রধান সীমাবদ্ধতা হিসেবে করম সংগ্রহ ও খরচের বিষয়টি সামনে আনেন অধ্যাপক জামাল। তিনি বলেন, এক কেজি জাফরানের জন্য অন্তত দেড় লাখ ফুলের স্টিগমা লাগে। চারা তৈরির জন্য প্রতিটি করমের দাম পড়ে ন্যূনতম ৬০ টাকা করে। সে হিসাবে দেড় লাখ করমের দামই আসে নয় লাখ টাকা। এর সঙ্গে ঘরে দুটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, বাতি ও সার্বক্ষণিক দেখভালের জন্য একজন মানুষ দরকার।
তবে, খরচ কমিয়ে আনার জন্য একবার করম সংগ্রহ করে পরে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে অনেক চারা তৈরি করা সম্ভব বলে জানান তিনি। বলেন, ‘ঘরে জাফরান চাষের আরেকটি সুবিধা হচ্ছে, পর্যায়ক্রমিক চাষের মাধ্যমে সারা বছর এর ফলন পাওয়া সম্ভব। উন্মুক্ত পরিসরে বছরে যা একবারই পাওয়া যায়। এই গবেষকের বক্তব্য, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামেও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে জাফরান উৎপাদনের চেষ্টা চলছে। কিন্তু ওরা এখনও সফল হয়নি। বাংলাদেশে আমরা যতটুকু সফলতা অর্জন করেছি, তাতে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখন বাণিজ্যিক উৎপাদনেও যাওয়া যাবে।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন