চরম দুর্দিনে বেসরকারি চাকুরে-শ্রমজীবিরা
নিজস্ব প্রতিবেদক: গত মার্চ মাস থেকে স্কুল বন্ধ। এপ্রিল থেকে টিউশনিগুলোও বন্ধ, কেউ বাইরের মানুষকে ঘরে ঢোকাতে চাইছেন না। এমন অবস্থায় ফেলেছে দেশের বিপুল সংখ্যক বেসরকারি চাকরিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষকে। কেউ কেউ টিকতে না পেরে ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামের পথ ধরছেন।
দীর্ঘ ৬৬ দিন ছুটির পর গত ৩১ মে থেকে সীমিত পরিসরে অফিস-আদালত ও ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে দেয়া হয়। ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর দফায় দফায় ছুটি বাড়তে থাকে। সর্বশেষ গত ৩০ মে শেষ হয় টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি। দীর্ঘ ছুটি, লকডাউনের কারণে সরকারি চাকরিজীবী ও নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ী ছাড়া বেসরকারি বিভিন্ন খাতের চাকুরে ও শ্রমজীবী মানুষের দুর্দিন চলছে।
সিডিপি বলছে, আয় কমে যাওয়ায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের হার ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। পাশাপাশি আয় ও ভোগের বৈষম্যও বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, তখন দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ২৪ শতাংশ। ২০১৯ সাল শেষে অনুমিত হিসাবে তা নেমে আসে সাড়ে ২০ শতাংশে। সিপিডি বলছে, কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, মানুষের আয় কমেছে। ফলে দারিদ্র্যের হারও বেড়ে গেছে।
সিপিডির মতে, গিনি সহগে ভোগের বৈষম্য বেড়ে দশমিক ৩৫ পয়েন্ট হয়েছে। ২০১৬ সালে এটি ছিল দশমিক ৩২ পয়েন্ট। একইভাবে আয়ের বৈষম্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৫২ পয়েন্ট। ২০১৬ সালের হিসাবে এটি ছিল দশমিক ৪৮ পয়েন্ট। সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল কিংবা সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারেনি। এতে একদিকে চাকরি হারিয়েছেন অনেকে, অনেকে কম বেতন পেয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সরকারঘোষিত ৬৬ দিনের লকডাউনে প্রায় পৌনে চার কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছে। এ সময়ে পাঁচ কোটি ৯৫ লাখ মানুষের শ্রেণী কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে দুই কোটি ৫৫ লাখ মানুষ হতদরিদ্র হয়েছে। তবে অতি-ধনীর অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে।
বিদেশে পণ্য পরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি কোম্পানির কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কোম্পানি তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও ওষুধ বিদেশে পরিবহনের কাজ করে। চলমান পরিস্থিতিতে ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে। এতে আমাদের কাজও কমে গেছে। প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে কিছু ছাঁটাই হয়েছে। বেশি বেতন নেয়া উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা লেবেলে ছাঁটাইয়ের একটি প্রক্রিয়া চলছে। এখানে কতদিন চাকরি করতে পারব জানিনা।
পোশাক খাতে ইতোমধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কাজ না থাকায় অনেক স্থানে কারাখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো কোনো কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। ছাঁটাই প্রক্রিয়া চলছে অধিকাংশ কারখানায়।
চলমান পরিস্থিতির মধ্যে বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) ব্যাংকারদের বেতন কমানোর পরামর্শ দিয়েছে সম্প্রতি। সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে কয়েকটি ব্যাংক এই পরামর্শ বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বেতন কমানো ও ছাঁটাই আতঙ্কে রয়েছেন ব্যাংক খাতের কর্মীরা।
শ্রমজীবী মানুষকেও বিপদে ফেলেছে। খেয়েপরে কোনোরকমে টিকে আছেন তারা। শনির আখড়ার গোবিন্দপুর এলাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করেন হাবিবুর রহমান। তিনি জানান, মানুষ খুব প্রয়োজন না হলে সেভাবে আর নির্মাণকাজে হাত দিচ্ছেন না। তাই কাজকর্ম নাই বললেই চলে। পেশা পরিবর্তন করে অন্যকিছু করার চিন্তা-ভাবনা করছেন বলেও জানান।
ঢাকা জেলা ট্রাক, ট্যাঙ্কলরি, কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সহ-সম্পাদক শিমুল বলেন, পণ্য পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরা ভালো নেই। পণ্য পরিবহনের বাহনগুলোর যে পরিমাণ ট্রিপ হওয়ার কথা সেই পরিমাণ হচ্ছে না। সরকার থেকে প্রতি মাসে আড়াই হাজার টাকা করে চার মাস যে টাকা দেয়ার কথা ছিল সেটাও পূরণ হয়নি। আর চাঁদাবাজি তো আছেই!
উপার্জন কমে যাওয়ায় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মতো সংকটে পড়েছেন বাড়ির ভাড়ার ওপর নির্ভরশীল বাড়িওয়ালারাও। আর্থিকভাবে সমস্যায় থাকায় ভাড়াটিয়ারা ঠিক মতো বাড়িভাড়া দিতে পারছেন না। পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেক বাড়িওয়ালাও ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ দিতে পারছেন না। লকডাউন শুরু হলে অনেকে বাসার কাজের বুয়া বিদায় করে দেন। এতে কাজের বুয়ারা বিপদে পড়েছেন, কষ্টে আছেন তারাও।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন