ঘোষিত মূল্যে পাওয়া যাচ্ছেনা ডলার
নিজস্ব প্রতিবেদক: আমদানিকারকরা চাইছেন কম মূল্যে ডলার পেতে। রপ্তানিকারকরা ডলারের বেশি মূল্য পেতে রপ্তানি বিল নিয়ে এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে যাচ্ছেন। রেমিট্যান্স হাউজগুলোও বেশি মূল্যে রেমিট্যান্সের অর্থ বিক্রির জন্য ব্যাংকগুলোর সঙ্গে দরাদরি করছে। প্রতিনিয়ত চাহিদা বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দরে ডলার বিক্রি করছে না কেউই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষণা অনুযায়ী, গতকাল প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময়মূল্য ছিলো ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। যদিও এ দামে দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানেই ডলার পাওয়া যায়নি। আন্তঃব্যাংক লেনদেনেই ডলারের দর উঠেছে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা। এ দামেই রেমিট্যান্স হাউজ মানিগ্রাম ও ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন থেকে ডলার কিনেছে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো। আর খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেট) প্রতি ডলার ৮৭ টাকা ৫০ পয়সারও বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
যদিও ডলারের অব্যাহত চাহিদা সামাল দিতে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছে ২৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। তারপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে টাকার অবমূল্যায়ন করতে হচ্ছে। গত ৩ বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার অবমূল্যায়ন ঘটালেও লাগাম নিজের হাতে রেখেছে। এজন্য ধীরলয়ে ৫ পয়সা করে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। ডলারকে বাজার পরিস্থিতির ওপর ছেড়ে দিলে পরিস্থিতি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠতে পারে।
ডলারের দর বাজারের চাহিদা ও জোগানের ওপর ছেড়ে দেয়া দরকার বলে জানান ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, এতে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার সমন্বয় হয়ে স্থিতিশীল হবে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সেও বড় প্রবৃদ্ধি আসবে। তবে এটি পুরোপুরি ছেড়ে দিলে বাজার অস্থিতিশীলও হয়ে উঠতে পারে। এজন্য প্রয়োজন যথাযথ সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত দরে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না উল্লেখ করে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, রেমিট্যান্স হাউজগুলো থেকে বাড়তি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। একইভাবে রপ্তানিকারকরাও ডলারের দাম নিয়ে দরকষাকষি করছেন। এজন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত দরে ডলার কেনা সম্ভব হচ্ছে না। দেশে একই সঙ্গে বিপুল উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে। বড় বড় অবকাঠামোর জন্য এলসি খুলতে হচ্ছে। কিন্তু রপ্তানি আয় নেতিবাচক হওয়ায় ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না।
সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যের সঙ্গে খুচরা বাজারে ডলারের দর এক-দেড় টাকা পর্যন্ত ব্যবধান থাকে। বর্তমানে এ ব্যবধান ৩ টাকা ছাড়িয়েছে। ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের পর থেকে কার্ব মার্কেটে ডলারের চাহিদা অস্বাভাবিক বেড়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ টাকার পরিবর্তে ডলার সংরক্ষণের প্রবণতা বৃদ্ধি ও দেশ থেকে নগদ ডলার পাচারের কারণেই এ তারতম্য তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডলার ক্রয়ে অনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস-উল-ইসলাম। তিনি বলেন, আমাদের সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের এলসি খোলা ও দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো বেশি দামে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কিনে নেয়। কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক সরকার ঘোষিত ২ শতাংশের অতিরিক্ত আরো ১ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পক্ষে এটি করা সম্ভব নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানি এলসির জন্য এক পয়সাও বেশি দেয় না। ফলে দিন শেষে আমাদের লোকসান দিতে হচ্ছে।
যদিও দর স্থিতিশীল রাখতে রিজার্ভ থেকে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংককে রেকর্ড ২৩৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করতে হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও বিক্রি করতে হয়েছিলো ২৩১ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজারে ১৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রির বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১৯৩ কোটি ১০ লাখ ডলার ক্রয় করেছিলা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাজারে ডলার বিক্রির দরকার হয়নি। ওই অর্থবছর বাজার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ৪১৩ কোটি ১০ লাখ ডলার কিনেছিলো।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন