বিশ্বজুড়ে তেলের দাম কমলেও এখনো কমেনি বাংলাদেশে
গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অব্যাহতভাবে কমতে থাকলেও বাংলাদেশে এখনো কমেনি।
বাংলাদেশে সবশেষ তেলের দাম পরিবর্তন করা হয়েছিল ২০১৩ সালে। তখন বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ১১০ ডলার, আর এখন তা নেমে এসেছে ২৭ ডলারে। কিন্তু বাংলাদেশে তেলের দামে তার কোনো প্রভাব পড়েনি।
বরং তেল বিক্রি থেকে দেশটির পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের মুনাফা বাড়ছে।
তেলের দাম কেন কমছে না- এ প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান এ এম বদরুদ্দোজা বলছেন, তেলের দাম সরকারের নির্বাহী আদেশে বাড়ানো হয়, এ ব্যাপারে তাদের কোনো হাত নেই।
তবে অর্থনীতিবিদিরা বলছেন, তেলের দাম কমালে সার্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিশ্বজাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় উৎপাদনকারী দেশগুলো সমস্যায় পড়লেও বাংলাদেশের মতো আমদানিকারক দেশগুলো স্বস্তিতেই আছে।
দেশটির পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের মুনাফা বাড়ছে। কর্পোরেশনটির কর্মকর্তারা বলছেন, এই মুনাফা আগামীতে ১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে, এবং এই মুনাফার অর্থ দিয়ে তারা বিভিন্ন সংস্থার কাছে থাকা দেনা শোধ করছেন।
সমপ্রতি ইরানের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক অবরোধ প্রত্যাহারের পর বিশ্ব বাজারে ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন দরে তেল বিক্রি হচ্ছে। উৎপাদন বাড়িয়ে ইরান যখন বিশ্ববাজারে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে তার আগে থেকেই তেলের বাজারে রেকর্ড দরপতন হয়েছে।
বিবিসি’র বাণিজ্য বিষয়ক সংবাদদাতা অ্যান্ড্রু ওয়াকার বলছিলেন, দরপতনের সবচে বড় কারণ হচ্ছে বাজারে তেলের অতিরিক্ত সরবরাহ। এই মুহূর্তে বাজারে তেলের প্রচুর যোগান রয়েছে। আমেরিকার শেল অয়েলের উৎপাদন বৃদ্ধি যেমন এর একটি কারণ আবার সৌদি আরবসহ ওপেকভুক্ত দেশগুলো উৎপাদন কমায়নি।
চাহিদা কমে যাওয়া অন্যতম কারণ উল্লেখ করে ওয়াকার বলেন, ২০১৪ সালের জুনের তুলনায় তেলের দাম এখন ৭০ ভাগ কমেছে। আর ইরান ইস্যুতে তেলের বাজার আরো অবনতির লক্ষণই দেখতে পাচ্ছেন তিনি।
‘ইতোমধ্যে আমরা এটা লক্ষ্য করেছি। তেলের বাজারে ইরান আসতে যাচ্ছে এমন সম্ভাবনা গত কয়েক মাসে ধরেই আলোচনায় ছিল। তার প্রভাব বাজারে পড়েছে। আর ইরানের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়ার ঘোষণায় আরো দরপতন হয়েছে। এমন কিছু ঘটছে না যাতে দাম বাড়তে পারে। আমি তো দেখছি সামনে তেলের দাম আরো কমবে।
এদিকে তেলের দাম কমে যাওয়ায় উৎপাদনকারী দেশগুলো যখন হিমশিম খাচ্ছে তখন বাংলাদেশের মতো আমদানিকারক দেশগুলো স্বস্তিতে আছে। প্রতি ব্যারেল তেল ৪০ ডলারের বেশি দরে কেনার পরও প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনে ২০ টাকা, পেট্রোলে ৩৫ টাকা আর অকটেনে ৪০ টাকা মুনাফা করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন।
বিপিসি তথ্য অনুযায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ বাজারে তেল বিক্রি করে মুনাফা হয়েছে ৫ হাজার ২শ ৬৮ কোটি টাকা। বিপিসির চেয়ারম্যান এ এম বদরুদ্দোজা জানান, এই বছরে আশা করছি আমরা উদ্বৃত্ত আরো একটু বেশি হবে। যদি এইভাবে তেলের দাম থাকে আন্তর্জাতিক বাজারে তাহলে আমাদের ধারণা যে নয় থেকে দশ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে।
তেল বিক্রির মুনাফা থেকে বিপিসি তাদের পুরোনো সব দায় দেনা পরিশোধ করেছে। যদিও বিগত দশ বছরে সরকার থেকে ভর্তুকী হিসেবে পাওয়া ২৬ হাজার ৩শ ৪৯ কোটি টাকা সরকারি ঋণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
মিস্টার বদরুদ্দোজা বলেন, বিভিন্ন সংস্থার কাছে আমাদের দেনা ছিল আমরা পরিশোধ করেছি। এটা একটা বিশাল অঙ্ক প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা আমরা এই দায় দেনা পরিশোধ করেছি সো ফার, এই লাভ হওয়ার পর থেকে।
তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ বাজারে তেলের দাম কমানোর ক্ষমতা সরকারের। তারা নির্বাহী আদেশে এই দাম পরিবর্তন করে থাকেন, এ ব্যাপারে কর্পোরেশনের কোনো হাত নেই।
বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের সবচে বেশি চাহিদা যোগাযোগ, বিদ্যুৎ এবং কৃষি খাতে। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে মোট জ্বালানি তেলের ৪৬ শতাংশ চাহিদা রয়েছে। এর পরেই আছে বিদ্যুৎ খাত যেখানে ২৫ শতাংশ তেলের ব্যবহার হয়। আর কৃষি উৎপাদনের প্রয়োজন পুরো চাহিদার ১৭ শতাংশ জ্বালানি তেল।
বাংলাদেশে ধান উৎপাদনের সবচে বড় মৌসুম বোরো আবাদে সেচপাম্পের প্রায় ৭০ ভাগই ডিজেল চলে। ডিজেল চালিত পাম্প দিয়ে চাষাবাদ করেন নরসিংদীর কৃষক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীন। তিনি বলছিলেন, জমিচাষ, সেচ এবং ফসল পরিবহন কাজে খরচ বেড়ে যায় তেলের কারণে। তেলের দাম কমলে প্রতি বিঘায় কৃষকের খরচ কমবে বলে জানান তিনি।
‘লিটার প্রতি দশ টাকা কমলে দুই হাজার টাকা বাঁচবো এহনতো পানি দেয়া লাগে তিন মাস। তিন মাস পানি দেয়ার পরে গিয়া ধান অইব। এহন তেলের দামডা কমলে আমরার শান্তি’।
বাংলাদেশে কৃষিসহ পণ্য উৎপাদনে তেলের ব্যবহার এবং অর্থনীতিতে এর প্রভাব বিশ্লেষণ করে গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলেছে, তেলের দাম কমিয়ে দিলে সার্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সিপিডির গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছিলেন, অন্যান্য দেশগুলোতে যেহেতু জ্বালানি তেলের নিম্নদরটি সমন্বয় হচ্ছে ফলে সেসমস্ত দেশের উৎপাদকরা এখন আরো কমমূল্যে তাদের পণ্য উৎপাদন করতে পারছেন। ফলে সেখানে একটি বাড়তি প্রতিদ্বন্দ্বিতা সক্ষমতার সুযোগ পাচ্ছেন সেসমস্ত দেশের উৎপাদকরা আমাদের দেশের উৎপাদকদের তুলনায়। সেটি কিন্তু আমাদের জন্য একটি বাড়তি চাপ। আবার ভোক্তা পর্যায়েও অন্যান্য দেশের যারা ভোক্তা রয়েছেন তারাও বিভিন্নভাবে সুবিধা পাচ্ছেন যেটা আমাদের দেশের ভোক্তারা এ পর্যায়ে পাচ্ছেন না। ফলে এক ধরনের অসম পরিস্থিতি উৎপাদক, ভোক্তা এবং সরকারের আয়ের দিক থেকে চিন্তা করলে এ মুহূর্তে যাচ্ছে বাংলাদেশে।
একই সঙ্গে ড. মোয়াজ্জেম বলছিলেন, সেচ মৌসুমে তেলের দাম কমালে সরাসরি কৃষক উপকৃত হবেন। তবে তেলের দাম কমানোর পর তার সুফল নিশ্চিত করতেও সরকারকে তৎপর থাকতে হবে।
‘কারিগরি ভাষায় আমরা বলি যে প্রাইস ইজ স্টিকি ডাউনওয়ার্ড মানে- কম কমে আসলে নিচের দিকে। অর্থাৎ সুবিধার যতটা হিসেব আমরা দিচ্ছি সেটা বাস্তবে গিয়ে সকল পর্যায়ে সমভাবে এই সুবিধা পাবে কিনা সেটি নির্ভর করছে সরকার কিভাবে এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবেন তার ওপর।
সর্বশেষ ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয় যখন বিশ্ব বাজারে ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ১১০ ডলার।
২০১৬-র ২০ জানুয়ারি একই তেলের দাম কমে ২৭ ডলারে ঠেকেছে। সূত্র : বিবিসি বাংলা।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন