সীমান্ত হত্যা: ‘মারবো না’ বলেও গুলি করছে হানাদার বিএসএফ!
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশকে সবসময়ই ভারতীয় পক্ষ সীমান্ত হত্যা বন্ধের আশ্বাস দেয়। আদৌ কি সীমান্তের হত্যা বন্ধ হয়েছে? গত সোমবার (১২ জুলাই) ভোররাতে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে সীমান্তে বিএসএফের (ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী) গুলিতে আব্দুর রাজ্জাক (২৫) নামে এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হয়েছেন। এর আগে ২০ মার্চ (শনিবার) ভোর ৪টার দিকে মৌলভীবাজারের জুড়ি সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত হন বাপ্পা মিয়া (৪০)।
শুধু রাজ্জাক বা বাপ্পা মিয়া নন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গত তিন বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ১০৭ বাংলাদেশি। বিপরীতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) গুলিতে নিহত হয়েছে মাত্র এক ভারতীয় নাগরিক। একাধিকবার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, মৌখিক আশ্বাস দিয়ে সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোঠায় নিতে সম্মত হয় দুই দেশ। তবে কথা রাখছে না প্রতিবেশী দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। সীমান্তে বাংলাদেশিদের বুকে গুলি চালিয়েই যাচ্ছে তারা!
জানা গেছে, অধিকাংশ সময়ই এসব হত্যাকে ‘আত্মরক্ষা’ বলে সাফাই গায় বিএসএফ। অথচ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে করা তদন্তে দেখা গেছে, সীমান্তে নিহত কোনো বাংলাদেশির কাছে থাকে না কোনো আগ্নেয়াস্ত্র।
২০২০ সালে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ৪২ বাংলাদেশি। মারধরসহ শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছে ছয়জন। গত তিন বছরে ১০৭ বাংলাদেশি নিহত হন, ভারতে মারা যায় মাত্র একজন। ‘সীমান্তে মৃত্যু শূন্যে আনার’ প্রতিশ্রুতির মধ্যেও এমন হত্যা বাংলাদেশকে ভাবিয়ে তুলেছে। শুধু হত্যাই নয়, সীমান্ত এলাকা থেকে ৪৮ বাংলাদেশিকে তুলে নিয়ে করা হয়েছে নির্মম নির্যাতনও
দুই যুগ ধরে চলছে এমন হত্যাকান্ড
গত ২০ বছরের পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ। ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এ সময়ে মোট ১ হাজার ২৩৬ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এ সংখ্যাটা আনুষ্ঠানিক। সীমান্ত এলাকা থেকে এ সময়ের মধ্যে নিখোঁজ হয়েছে ১১১ জন। তাদের ভাগ্যে কী জুটেছে, সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর নেই কারও কাছে। বিজিবির কাছে বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কাউকে গুলির আগে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। বরং গুলি করে সীমান্তবর্তী থানাগুলোতে একে ‘আত্মরক্ষা’ বলে রেজিস্ট্রার করে বিএসএফ।
২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল বিকেলে কুড়িগ্রামের সীমান্তঘেঁষা মাঠে গরু চরাচ্ছিলেন রাসেল মিয়া নামের নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। বিকেল পৌনে ৪টায় ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের সদস্যরা এসে হাজির হন শূন্য রেখার বাংলাদেশ অংশে। রাসেল ভয়ে নদীতে নামলে বিএসএফ সদস্যরা তাকে লক্ষ্য করে শটগান থেকে গুলি ছোঁড়েন। রাসেলের পুরো মুখ ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তিনি আর নদী থেকে ডাঙায় উঠতে পারেননি। পরে আশপাশের লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করেন।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় রাসেলের। তিনি বলেন, ‘তারা (বিএসএফ) মদ্যপ ছিল। সীমান্তে এসেই এলোপাতাড়ি গুলি করে। আমার মুখে গুলি লাগে। ডান চোখে আর কখনওই দেখতে পাব না। বাম চোখে ঝাপসা দেখি। চোখে-মুখে রাবার বুলেট (স্প্লিন্টার) ঢুকে আছে। এগুলোও বের করা লাগবে। আমি তো আর চোখে দেখতে পাই না, আমার পড়াশোনার কী হবে? বিএসএফ শুধু আমার চোখই নয়, জীবনটাও নষ্ট করে দিয়েছে।’
চোখে-মুখে রাবার বুলেট ঢুকে আছে, এগুলোও বের করা লাগবে। আমি তো আর চোখে দেখতে পাই না, আমার পড়াশোনার কী হবে? বিএসএফ শুধু আমার চোখই না, জীবনটাও নষ্ট করে দিয়েছে
রাসেলের বিষয়ে বিজিবি ওই সময় প্রতিবাদ করে। উত্তরে বিএসএফ জানায়, ঘটনাটি ছিল ‘চোরাকারবারিদের আক্রমণ’। তবে বিজিবির তদন্তে জানা যায়, ক্ষতিগ্রস্তের পরিবারের কেউ চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত নয়, ছিলও না।
শুধু রাসেল নন, এমন নৃশংসতার শিকার হন আজিমউদ্দিন নামের এক গরু ব্যবসায়ীও। ২০১৯ সালের এপ্রিলে ওপারে গরু আনতে যান তিনি। ফেরার সময় তাকে ধরে প্লাস (সাঁড়াশি বিশেষ) দিয়ে তুলে নেওয়া হয় হাতের নখ। যন্ত্রণায় আজিম বারবার বিএসএফকে বলেছিল, ‘আমাকে মেরে ফেলুন’। নির্যাতনের পর তাকে বিজিবির হাতে তুলে দেওয়া হয়। নির্মম ওই নির্যাতনের স্মৃতি এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এখনও আঁতকে ওঠেন আজিমউদ্দিন।
বিএসএফ আগে গুলি করে, পরে কথা বলে:
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘সীমান্তের হত্যা কমবে না, সংখ্যাটাও নিচে নামবে না। কারণ, ভারতের বিএসএফকে আমি সবসময় ট্রিগার হাতেই দেখি। তারা গুলি করার জন্য প্রস্তুত থাকে। আগে গুলি করে, পরে কথা বলে।’
তিনি বলেন, ‘বিএসএফের বেশিরভাগ সদস্যই অবাঙালি। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তারা এখনও মনে করে যে, বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুধার্ত, বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশ। তাই তারা ভারতে যায়। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। বিষয়টি ভারতের পলিটিক্যাল লেভেল (রাজনৈতিকভাবে) থেকে বিএসএফকে সেভাবে বার্তা দেওয়া হয় না অথবা বিএসএফ তাদের কথা শোনে না।’
‘আমার মতে, যদি ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চায়, তাহলে তাদের নিচের লেভেলে (বিএসএফ) অ্যাকশন নিতে হবে। তবে এ ধরনের অ্যাকশন তারা আগে কখনও নেয়নি। এমনকি ফেলানীর ঘটনায়ও কিছু হয়নি। পলিটিক্যাল লেভেল থেকে শক্ত বার্তা না দিলে সীমান্তের হত্যার কোনো সুরাহা হবে না। এ হত্যাকা- বাড়তে থাকলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব আরও প্রখর হবে’- যোগ করেন তিনি।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন