লকডাউনে বহুমুখী ক্ষতিতে দেশের অর্থনীতি
নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচকের নিম্নমুখী প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশজুড়ে লকডাউনের প্রভাব। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, লকডাউনের কারণে দেশের অর্থনীতির সব সূচক এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আমদানি ও রফতানি আয়ে কোনও প্রবৃদ্ধি নেই। সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে সীমিত আয়ের মানুষ। বিনিয়োগ একেবারেই হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে না।
আরও খারাপ খবর হচ্ছে, ঋণ করে কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছে গার্মেন্ট মালিকরা। একইভাবে সরকারও ঋণ করে কর্মচারীদের বেতন ভাতা দিচ্ছে। চলতি বছরে সরকার ৮০ হাজার কোটি টাকার ঋণ ইতোমধ্যে নিয়ে ফেলেছে, যা স্বাধীনতার পর থেকে এক বছরের হিসেবে সর্বোচ্চ। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে যে, এখন সরকারকে ঋণ দিতে গিয়ে এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে ব্যাপকহারে রিজার্ভ মানি (আরএম) বা হাই-পাওয়ার্ড মানি বাজারে সরবরাহ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই রিজার্ভ মানি হচ্ছে ছাপানো টাকা।
সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে সীমিত আয়ের মানুষ:
চলমান লকডাউনে সীমিত আয়ের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। অনেকে বেতন পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে তারা তাদের জমানো সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করার পরিমাণ ভয়াবহভাবে কমছে। একইভাবে বাড়ছে সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর প্রবণতা। গত ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে যত সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে আগের কেনা সঞ্চয়পত্র মেয়াদপূর্তির কারণে ভাঙানো হয়েছে বেশি।
ঋণ নিচ্ছে না বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা:
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছে, একদিকে ঋণ বিতরণ হচ্ছে না, অন্যদিকে ব্যাংকে রাখা নগদ টাকা তুলে নিচ্ছেন অনেকেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে, বেসরকারি খাতের ঋণ বিতরণ ভয়াবহভাবে কমে গেছে। তবে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি এই এক মাসে মাত্র ৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। এই অংক গত বছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বেশি। জানুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৫২ হাজার ৪৭৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
রফতানি আয়ে বিপর্যয়:
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত এপ্রিল মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি আয় কমেছে ৮৩ শতাংশ। লকডাউনের কারণে গত এপ্রিল মাসে পণ্য রফতানি হয়েছে ৫২ কোটি ডলার। আগের বছরের এপ্রিলে রফতানি হয়েছিল ৩০৩ কোটি ৪২ লাখ ডলার। যা গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ৮২ দশমিক ৮৬ শতাংশ কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ২ হাজার ৯৪৯ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ শতাংশ কম।
নিম্নমুখী প্রবাসী আয়:
লকডাউনের কারণে বিশ্বের অনেক দেশেই লকডাউন চলছে। এর মধ্যেও দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্স পাঠানো অব্যাহত রেখেছেন। তবে তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। গত এপ্রিল মাসে প্রবাসীরা ১০৮ কোটি ৬৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। আগের বছরের একই মাসে এসেছিল ১৪৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। অর্থাৎ রেমিট্যান্স কমেছে ২৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। প্রবাসে কাজ করা বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি দেশে ফিরে এসেছেন গত চার মাসে। তারা যদি আর কাজে ফিরতে না পারেন তাহলে এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ দিনে দিনে কমতেই থাকবে বলে আশঙ্কা রয়েছে অর্থনীতিবিদদের।
কমে যাচ্ছে তৈরি পোশাকের অর্ডার:
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল হয়েছে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, লকডাউনের প্রভাবে এখন পর্যন্ত ৩১৮ কোটি ডলারের রফতানির অর্ডার বাতিল করেছেন ক্রেতারা। এর ফলে ১ হাজার ১৫০টি কারখানার ২২ লাখ ৮০ হাজার শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাকি অর্ডারগুলো বাতিল হয়েছে বিকেএমইএর মালিকদের কারখানায়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন,, লকডাউনের কারণে একটা বিপর্যয় আসতে পারে, সেটা আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল। বিশেষ করে পণ্য রফতানিতে ধাক্কা আসার বিষয়টি সবার জানা ছিল। কারণ, পোশাকের অনেক ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। তা ছাড়া আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকা- প্রায় বন্ধ। অন্যদিকে, প্রবাসী শ্রমিকেরা যেসব দেশে কাজ করেন সেসব দেশেও অর্থনৈতি কর্মকা- এখনও শুরু হয়নি। ফলে প্রবাসী আয়ও কমে গেছে।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন