স্টাফ রিপোর্টার ঃ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) প্রতি পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয় বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন থেকে শুরু করে প্রকাশনা পর্যন্ত যেমন- পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন প্রক্রিয়া, লেখা নির্বাচন, শব্দ চয়ন ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগসহ সব ক্ষেত্রে অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। এনসিটিবির কর্মকর্তারা এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। একটি স্বাধীন কমিশন করার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডি টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি): পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন ও প্রকাশনা ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনটি ২০১৬ সালের অক্টোবর মাস থেকে ২০১৭ এর অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে তৈরি করা হয়। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবি’র ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোরশেদা আক্তার। এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা ড. সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান এবং সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম উপস্থিত ছিলেন। প্রতিবেদনের সার্বিক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এনসিটিবির পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ, সঠিকভাবে পাণ্ডুলিপি লেখা হচ্ছে না, দলীয় রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত প্রভাব বিদ্যমান। পাঠ্যবই ছাপায় দুই ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। প্রথমত, ব্যক্তিগত আর্থিক সুবিধা আদায় এবং কার্যাদেশ প্রদানে দুর্নীতি। প্রতিবেদনে এসব সমস্যার সমাধানে বেশ কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশনা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত লোকজন বিভিন্ন পর্যায়ে সুযোগ-সুবিধা নেয়া, নিজস্ব প্রকাশনার মাধ্যমে বই মুদ্রণ, অবৈধভাবে কাজ পাইয়ে দেয়াসহ নানা উপায়ে দুর্নীতি করে। এনসিটিবি এখনও সম্পূর্ণ কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি। এটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিমালা নেই। স্বাধীন কমিশন করে তাদের সকল বিষয়ে নজর দিতে হবে।
টিআইবি তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, এনসিটিবি কার্যক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান রয়েছে। পাঠ্যবই প্রকাশনা প্রক্রিয়ায় নানা দুর্নীতি ও অনিয়ম ধরা পড়েছে। পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায়ও রয়েছে অস্বচ্ছতা। সঠিকভাবে পাণ্ডুলিপি না লিখে দলীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শগত ব্যক্তির দ্বারা এ প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হচ্ছে। সক্ষমতা ও পেশাগত দক্ষতায় রয়েছে বিশেষজ্ঞ, জনবল ও কারিগরি ঘাটতি। পরিদর্শন তদারকিতে দেখা গেছে মানসম্মত ও সঠিক সময়ে বই সরবারহ না করা। অন্যদিকে বিষয় বিশেষজ্ঞ নিয়োগে অনিয়ম পাওয়া গেছে। কোনো কোনো বিষয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিশেষজ্ঞ নিয়োগ আবার কোনো বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞও নেই। অন্যদিকে পাণ্ডুলিপি প্রণয়নে দেখা গেছে নানা অসঙ্গতি। মূল কবিতা বিকৃতি, বানান ভুল, ছবির সঙ্গে বিষয়বস্তুর সম্পর্ক নেই, ভুল যাচাইয়ের কপি সংরক্ষণ না করা, ভুল সংশোধন করতে গিয়ে নতুন করে ভুল করা ইত্যাদি। এনসিটিবিতে সব থেকে দুর্নীতির জায়গা হচ্ছে নিয়োগ ও প্রকাশনার কাজে। এখানে স্বজনপ্রীতি ও তদবিরের মাধ্যমে নিয়োগ দিতে দেখা গেছে। মুদ্রণের ক্ষেত্রে সরকারদলীয় মন্ত্রী, এমপি ও নেতাদের প্রকাশনায় কাজ দেয়া। নিষেধ থাকলেও এনসিটিবির কর্মকর্তারাও নিজেরাই এ কাজে জড়িয়ে পড়ছেন।
টিআইবির গবেষণায় বলা হয়, একটি গোষ্ঠীর দাবির ফলে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ৫টি বই থেকে ১৬টি লেখা বাদ দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে ১১টি ওই গোষ্ঠীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাদ দেয়া হয়েছে। পাণ্ডুলিপি প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় বলা হয়, কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের মতাদর্শীদের প্রাধান্য দেয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে কাউকে কমিটি থেকে বাদ দেয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লেখা নির্বাচনে সামপ্রদায়িক মতাদর্শের প্রভাব দেখা যায়। আবার সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যবইয়ের কোনো কোনো বিষয় এবং শব্দ পরিবর্তন করা হয়। গবেষণায় বলা হয়, শিক্ষাক্রম অনুসরণ না করেই অনেক সময় অনিয়মতান্ত্রিকভাবে লেখা পরিবর্তন করা হয়।
পাঠ্যবই ছাপার ক্ষেত্রে বলা হয়, এনসিটিবির কর্মকর্তাদের একাংশ পাঠ্যবই ছাপার দরপত্র আহ্বানের আগেই প্রস্তাব অনুযায়ী প্রাক্কলিত দর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দেয়। পরে এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে দরপত্র দাখিল করে। বিতরণ পর্যায়েও নানা ধরনের অনিয়ম হয় বলে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়। এ বিষয়ে বলা হয়, কয়েকটি জেলায় নির্ধারিত সময়ে পাঠ্যবই সরবরাহ করা না হলেও পরে সঠিক সময়ে প্রাপ্তি প্রতিবেদন দেয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এনসিটিবি মোটামুটি সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় তাদের বিভিন্ন পর্যায়ে বাধাগ্রস্ত হতে হয়। তারা চাইলেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। সব সরকার দ্বারা তারা প্রভাবিত হয়ে এসেছে। ২০১৭ সালে এনসিটিবি ২৫ কোটি ৪৩ লাখের উপরে বই মুদ্রণ ও বিতরণ করেছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের একটি। আমাদের গবেষণায় পাণ্ডুলিপি প্রক্রিয়া ও প্রকাশনায় ৭টি বিষয় তুলে আনা হয়েছে। অন্যদিকে আইন ও নীতি সংস্কারের জন্য ১০টি সুপারিশ প্রধান করা হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে এনসিটিবি কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে রূপ পাবে।
(0) মন্তব্য
কোন মন্তব্য নেই!
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন