পাচারকারীদের ‘টর্চার সেল’ কলকাতায়, জানালো র্যাব
নিজস্ব প্রতিবেদক: অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে কলকাতার টর্চার সেলে বাংলাদেশি নাগরিকদের আটকে রাখার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে র্যাব। মঙ্গলবার কারওয়ান বাজারের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৪ এ কথা জানায়।
সংবাদ সম্মেলনে পাচারের শিকার দুই ব্যক্তিকে হাজিরও করেছিল তারা। র্যাব জানিয়েছে, ভুক্তভোগীদের পাচারের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তারা তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
র্যাব-৪-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোজাম্মেল হক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বাংলাদেশে মানব পাচারকারী এই চক্রের আরও ৮ থেকে ১০ জন সদস্য আছে। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা ভারতে থাকা তাঁদের আরও তিনজন সহযোগীর নাম জানিয়েছে।
মানব পাচারকারী এই চক্রের কার্যক্রম সম্পর্কে র্যাব জানায়, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হিসেবে যেতে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তিদের নিশানা করত চক্রটি। তাদের খপ্পরে পড়া ব্যক্তিদের মধ্যে ফেনী, কুমিল্লা, নবাবগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকার মানুষ রয়েছে। চক্রের সদস্যরা ভুক্তভোগীদের অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ড, রোমানিয়া, গ্রিস, ফ্রান্স ও মাল্টায় বেশি বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখাত। তারা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করত। কিন্তু প্রতিশ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার বদলে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হতো কলকাতায়। সেখানে ভুক্তভোগীদের নির্যাতন করে অডিও ও ভিডিও দেশে পাঠিয়ে চক্রের সদস্যরা টাকা আদায় করতো।
সম্প্রতি ভারত থেকে ফিরেছেন এমন একজন ভুক্তভোগী জাহাঙ্গীর। তিনি র্যাব-৪-এর কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। ২০১৯ সালে জাহাঙ্গীর চক্রের সদস্য মল্লিক রেজাউল হক সেলিম ও বুলবুল আহমেদ মল্লিকের খবর পান। তাঁরা জাহাঙ্গীরকে অস্ট্রেলিয়া ও তার ভাগনে আকাশকে নেদারল্যান্ডে পাঠানোর কথা বলে ৩৪ লাখ টাকা দাবি করেন। ওই বছরের ১০ অক্টোবর মামা-ভাগনে দুই দফায় ১৪ লাখ টাকা দেন। নকল ভিসা দেখিয়ে পরে এই দলটি তাঁদের ভারতে পাচার করে দেয়। কলকাতার টর্চার সেলে আটকে রেখে তারা তাঁদের বেদম মারধর করে। সাড়ে ৯ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে পরে তারা দেশে ফেরে।
পাচারকারী চক্রের অপর সদস্য নিরঞ্জন পাল পতুর্গাল ও মাল্টা পাঠানোর নাম করে বিল্লাল হোসেন, রবিন হোসেন ও শাহিন খানকে ভারতে পাচার করে। টর্চার সেলে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে ছয় মাস পর তারা ফিরে আনে।
র্যাব জানিয়েছে, নবাবগঞ্জের মল্লিক রেজাউল হক ১৯৮৩ সালে এসএসসি পাস করে সৌদি আরবে যান। তিন বছর পর দেশে ফিরে তৈরি পোশাক ও মানব পাচারে যুক্ত হয়। র্যাব জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছে ১৯৯২ সালে রেজাউল আবার দুবাইতে যায়। সেখানেই সে মূলত ভারতের মানব পাচারকারীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। ২০১০ সালে দেশে ফেরার পর কক্সবাজারে মাছের ব্যবসার আড়ালে মানব পাচার করতে শুরু করে সে। তার বিরুদ্ধে আগেও মানব পাচারের মামলা ছিল। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিপুল সম্পত্তি তাঁর। আছেন দুই স্ত্রী ও ছয় সন্তান।
বুলবুল আহমেদ মল্লিকের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ। সে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় কারখানা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৯৬ সালে দেশে ফিরে প্রথমে আমদানি–রপ্তানি ও পরে মানব পাচারে যুক্ত হয়। পল্লবীর পলাশনহরে তার সাততলা একটি বাড়ি, উত্তরা, মিরপুর ও হাজীপুরে ফ্ল্যাট, প্লট ও জমিজমা আছে। তাঁর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ২৪টি মামলা আছে।
নিরঞ্জন পালের বাড়িও নবাবগঞ্জ। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর রোমানিয়ায় যায়। ১৯৯৮ সালে দেশে ফিরে গার্মেন্টস পণ্য ব্যবসা শুরু করে। ২০০৭ সালে এ দেশে থাকা সব সহায়সম্পত্তি বিক্রি করে সে ভারতে চলে যায়। কলকাতার টর্চার সেলগুলো মূলত সেই চালায়। ভুক্তভোগীরা বলেন, টর্চার সেল পরিচালনাকারীদের সঙ্গে নিরঞ্জন নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো। বাংলাদেশ ও ভারতে নিয়মিত যাতায়াত করে নিরঞ্জন। কলকাতায় তার অনেক বিষয়সম্পত্তি রয়েছে বলেও জানিয়েছে র্যাব।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন