ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি; ১০ বছরেও শেষ হয়নি ৪ বছরের কাজ, খরচ দ্বিগুণ
নিজস্ব প্রতিবেদক: ক্রেন দুর্ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যুর পর নতুন করে আলোচনায় রয়েছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে গাজীপুরের যোগাযোগ সহজ-সময় সাশ্রয়ী করতে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১২ সালের ডিসেম্বরে। চার বছর মেয়াদান্তে কাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার কথা। তারপর কেটে গেছে আরও ছয় বছর। খরচ বেড়েছে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। এই দশ বছরে একাধিক দুর্ঘটনায় এই প্রকল্প কেড়েছে ছয় প্রাণ। চীনা নাগরিকসহ আহত হন আরও ৯ জন। আর ২০ কিলোমিটার (নিচ ও উড়ালসহ) রাস্তা তৈরি করতে ধুলাবালি, যানজটে সীমাহীন দুর্ভোগ তো নিত্যসঙ্গী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৭০ শতাংশের মতো। হাতে যে চার মাস সময় বাকি আছে তাতে কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। তার উপর উত্তরায় ক্রেন দুর্ঘটনার জেরে গত কয়েকদিন ধরে কাজ বন্ধ। ওই রুটে যে ৫০টি বাস চলাচল করবে সেগুলো কেনার পরিকল্পনাও এখনো চূড়ান্ত নয়। কবে নাগাদ বাসগুলো কেনা হবে, কোন দেশ থেকে কেনা হবে তারও কোনো সুরাহা হয়নি। আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাস কেনার কথা। আন্তর্জাতিক টেন্ডারে কেনাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ফলে আবারও বাড়াতে হবে প্রকল্পের সময়।
অন্যদিকে, উত্তরায় প্রাইভেটকারে গার্ডার পড়ে একই পরিবারের পাঁচ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনার পর থেকে প্রকল্পের সব কাজ বন্ধ। ফলে বেঁধে দেওয়া সময়ে প্রকল্পের সুফল ভোগ করতে পারছেন না নগরবাসী।
এর আগে গত বছরের ১৪ মার্চ ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে নির্মাণাধীন বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার পড়ে চারজন আহত হন। তাদের মধ্যে দুজন চীনের নাগরিক ছিলেন। এছাড়াও গত ১৫ জুলাই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর মহানগরীর চৌধুরীবাড়ি এলাকায় এ প্রকল্পের ফ্লাইওভারের লঞ্চিং গার্ডার গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় কাত হয়ে পড়ে জিয়াউর রহমান (৩০) নামে এক নিরাপত্তাকর্মীর মৃত্যু হয়। এ সময় এক পথচারী আহত হন।
ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (বিআরটি) পরিচালক (যুগ্ম-সচিব) ড. মনিরুজ্জামান বলেন, ক্রেন পড়ে নিহত হওয়ার ঘটনায় কাজ বন্ধ। এছাড়া কোভিডের সময়ও বন্ধ ছিল। ফলে এই সময়ে কাজ সমাপ্ত হওয়া নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
৫০টি আর্টিকুলেটেড বাস কেনা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাসের স্পেসিফিকেশন ঠিক হয়েছে। তবে কোন দেশ থেকে কেনা হবে কবে নাগাদ কেনা হবে তা ঠিক হয়নি। ইলেকট্রিক আর্টিকুলেটেড বাস বিদেশ থেকে কেনা হবে। এসি বাসগুলো চালক একাই অপারেট করবেন। প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ হয়নি। আশা করছি প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বাসগুলো কেনা হবে। বিআরটি পরিচালনার জন্য আইটিএস সরঞ্জামাদি, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রের ট্রাফিক সিগন্যাল সিস্টেম কেনা হবে। এছাড়া রুটে বাস অপারেটরদের সঙ্গে আলোচনা ও বাস অপারেটর নির্বাচনের দায়িত্বও থাকবে বিআরটিএর ওপর।
২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে ২ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকায় প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। বর্তমানে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। ফলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ২২৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা এবং মেয়াদ বেড়েছে ছয় বছর। মোট ব্যয়ের মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ১ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ ২ হাজার ৮৪২ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
বিআরটি সূত্র জানায়, আর্টিকুলেটেডবাসগুলো কখনো মাটি ঘেঁষে আবার কখনো এলিভেটেড সড়কে চলাচল করবে। এ বাস র্যাপিড ট্রানজিট চালু হলে দুর্ভোগের ঢাকা-গাজীপুর সড়ক মাত্র ৪০ মিনিটেই পাড়ি দেওয়া যাবে। আর এ রুটে বাস মিলবে দেড় থেকে তিন মিনিট পরপর।
১০ বছরেও শেষ হয়নি ৪ বছরের কাজ, খরচ দ্বিগুণ
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এ প্রকল্পে সড়ক হবে ২০ দশমিক ২০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ভূমিতে থাকবে ১৫ দশমিক ০৭ কিলোমিটার এবং উড়াল সড়ক হবে সাড়ে চার কিলোমিটার, যা নির্মাণের অগ্রগতি ৫০ দশমিক ৯০ শতাংশ। টঙ্গীতে ১০ লেন ব্রিজ তৈরি হচ্ছে, এর অগ্রগতি ৬০ দশমিক ৭০ শতাংশ। ছয়টি ফ্লাইওভার হচ্ছে, যেগুলোর মোট দৈর্ঘ্য দুই হাজার ৮১২ দশমিক ৫০ মিটার। এর মধ্যে বিমানবন্দর ফ্লাইওভার ৮১৫ মিটার, জসিমউদ্দিন ফ্লাইওভার ৫৮০ মিটার, কুনিয়া ফ্লাইওভার ৫৫০ মিটার, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি ফ্লাইওভার ৫৫০ মিটার, ভোগড়া ফ্লাইওভার ৫৮০ মিটার ও জয়দেবপুর ফ্লাইওভার ২ হাজার ১৪ মিটার। এ ছয় ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৭৩ দশমিক ৩০ শতাংশ।
গাজীপুরে একটি বাস ডিপো থাকছে, যার কাজ শতভাগ সম্পন্ন। রুটে মোট স্টেশন ২৫টি। থাকছে ৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ১১৩টি অ্যাকসেস রোড। প্রকল্পের আওতায় ২৪ কিলোমিটার হাই-ক্যাপাসিটি ড্রেন নির্মাণ কাজ চলমান, যার অগ্রগতি ৯৭ দশমিক ১০ শতাংশ। রুটের মোড়গুলোতে ট্রাফিক লাইট এবং ১৫০টি ক্লোজড-সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করা হবে।
এ প্রকল্পের আওতায় তুরাগ নদীর ওপর ১০ লেনবিশিষ্ট টঙ্গী ব্রিজ এবং ছয়টি এলিভেটেড স্টেশনসহ সাড়ে চার কিলোমিটার এলিভেটেড সেকশন নির্মাণ করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। এলজিইডির তত্ত্বাবধানে গাজীপুরে বিটিসিএলের জমিতে বিআরটি ডিপো, ১০টি কিচেন মার্কেট ও বিআরটি করিডোরের উভয়পাশে ১৪১টি অ্যাকসেস রোডের উন্নয়নকাজ চলছে। এছাড়া গাজীপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত প্রস্তাবিত করিডোর বরাবর এক হাজার জ্বালানি সাশ্রয়ী সড়কবাতি স্থাপন কাজও চলমান।
প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি) ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ) অর্থায়ন করছে।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন