হামলা-মামলায় গ্রামছাড়া ৬০ পরিবার, হচ্ছে না ৯১ বিঘা জমির আলুচাষ
নিউজ ডেস্ক: স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুপক্ষের হামলা মামলায় মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার চরকেওয়ার ইউনিয়নে ৬০টি পরিবার গ্রামছাড়া থাকার অভিযোগ উঠেছে। ফলে চলতি আলু আবাদের মৌসুম শেষ হতে চলেও তাদের প্রায় ৯১ বিঘা জমি অনাবাদী পড়ে আছে।
অভিযোগ উঠেছে, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জেলা পরিষদ সদস্য আক্তারুজ্জামান জীবন সমর্থিত মামুন হাওলাদার পক্ষের লোকজনের সঙ্গে বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসার উদ্দিন ভূঁইয়া সমর্থিত আহম্মদ হোসেন পক্ষের লোকজনের কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। এর জের ধরে ভুক্তভোগীদের এলাকায় ফিরতে দিচ্ছে না প্রভাবশালী মামুনের পক্ষের লোকজন। এ নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উভয়পক্ষ নিয়ে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে দফায় দফায় মীমাংসার চেষ্টা করলেও এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, গেলো ইউপি নির্বাচনে চরকেওয়ার ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ছিলেন আফসার উদ্দিন ভূঁইয়া। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন আক্তারুজ্জামান জীবন। নির্বাচনের আগে জীবন আফসারকে সমর্থন দিলেও দুটি পক্ষের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষ ঘটে।
সবশেষ ২০২২ সালের ১০ জুলাই ঈদুল আজহার পরদিন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খাসকান্দি ও ছোট মোল্লাকান্দি এলাকায় সংঘর্ষে জড়ায় দুপক্ষ। ঘটনার সময় গুলিবিদ্ধ হন উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন। এদের মধ্যে মামুন পক্ষের খাসকান্দি এলাকার মৃত বাচ্চু মুন্সির ছেলে রবিউল ইসলাম (১৮) বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। পরবর্তীতে তার বাম পায়ের নিচের অংশ কেটে ফেলতে হয়।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় আহম্মদ পক্ষের ৫১ জনকে আসামি করে মামলা করেন মামুন পক্ষের লোকজন। মামলার পর থেকে পরিবারসহ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন এজাহারে থাকা ৫১ জন আসামিসহ অন্তত ৬০ জন। গ্রামছাড়া এ পরিবারগুলো বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন বলে জানা গেছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ফেলে আসা ঘরবাড়িতে থাকা টিউবওয়েল, ফার্নিচার, জানালার গ্রিল, মোটর ইত্যাদি খুলে নিয়ে গেছে প্রতিপক্ষ মামুন হাওলাদারের লোকজন। এমনকি তাদের ফেলে আসা প্রায় ৯১ বিভা আবাদি জমি অনাবাদী অবস্থায় পড়ে আছে।
সোমবার সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, এক পাশের জমিতে আলুর গাছ বড় হচ্ছে। কিন্তু অন্যপাশে বিস্তীর্ণ জমি খালি পড়ে আছে।
স্থানীয় হোসেন হাওলাদারের স্ত্রী রোকেয়া বেগম (৩০) বলেন, ‘আগে আমাদের গ্রামে এত ঝগড়াঝাঁটি ছিল না। আলু লাগানোর মৌসুম প্রায় শেষ পর্যায়ে। আর মাত্র ১০ দিনের মধ্যে আলু না লাগালে জমিগুলো এভাবেই পড়ে থাকবে।’
খাসকান্দি এলাকার কোহিনুর বেগম বলেন, ‘আমার নাতি সাঈদ ইসলাম সিয়াম (১২) স্থানীয় কদমতলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। সে এ দুই পক্ষের মারামারির কারণে পরিবারসহ এলাকাছাড়া হওয়ায় ছয় মাস ধরে স্কুলে যেতে পারছে না। বর্তমানে তার লেখাপড়া বন্ধ আছে।’
ছোট মোল্লাকান্দি এলাকার হাজি সৈয়দ আহম্মেদ (৬৮) বলেন, ‘আমি প্রতিবছর সাড়ে তিন কানি জমিতে আলু রোপণ করি। এবছর মামুন হাওলাদার ও তার লোকজনের বাধায় জমি চাষ করতে পারিনি। আমিসহ স্থানীয় আরও ৬০টি পরিবার বাড়ি ছাড়া।’
অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘মামুনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দিলেও পুলিশ নেয় না। অথচ আমরা ঘটনাস্থলে না থাকলেও পুলিশ হুকুমের আসামি করে। স্থানীয় ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম হাওলাদারে কাছে এ বিষয়ে সহযোগিতা চাইলেও তিনি এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। প্রশাসনের কাছে আমরা আশা-ভরসা করি তারা নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু তারা তা করে না। পুরো পরিবার নিয়ে এখন মুন্সিগঞ্জ পৌর শহরের ইসলামপুর এলাকায় ভাড়া থাকি।’
খাসকান্দি এলাকার মজিবুর রহমান ব্যাপারী (৫৮) বলেন, ‘আমার চৌচালা ঘর ছিল। মামলার পর থেকে আমি গ্রামছাড়া। বাড়ির টিউবওয়েল তারা তুলে নিয়ে গেছে। ভবনের থাই গ্লাস ভেঙে ফেলেছে। নির্বিচারে তারা বাড়ি থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি লুটপাট করে নিয়ে গেছে।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, ‘সবশেষ চরকেওয়ার ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধ হয়। এরপর আমি দুপক্ষকে মিলেমিশে থাকার জন্য বারবার বলি। কিন্তু কেউই শোনেনি। সম্প্রতি আমরা উভয়পক্ষের লোকজনসহ পুলিশের উপস্থিতিতে বসি। সেখানে মামুনের পক্ষ থেকে গুলিবিদ্ধ রবিউলসহ আহতদের চিকিৎসা বাবদ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু পরে আর এ নিয়ে আপস-মীমাংসা হয়নি।’
অভিযোগের বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মামুন হাওলাদার বলেন, ‘গ্রামের বাড়ি ছোট মোল্লাকান্দি হলেও আমি ঢাকায় থাকি। বেশ কয়েকবছর ধরেই স্থানীয় দুপক্ষের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ চলে আসছে। সংঘর্ষের ঘটনায় অনেকের অঙ্গহানিও ঘটেছে। জমিতে চাষাবাদ যারা করতে পারেনি তারা ভয়ে নিজেরাই এলাকায় আসছেন না। তারা কেন আসছেন না আমার জানা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা জমিতে চাষাবাদ করতে পারেননি, তারা এলে আমি প্রয়োজনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের সহায়তা করবো। আর যার পা চলে গেছে তারা খুব ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তাদের ভয়ে ওই পক্ষের লোকগুলো নিজেরাই আসে না।’
চরকেওয়ার ইউপি চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘খাসকান্দি ও ছোট মোল্লাকান্দি এলাকার দীর্ঘদিনের বংশগত বিরোধের জের ধরে এখানে প্রায়ই সহিংস ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ নির্বাচনের সময় এ বিরোধ আরও চরম আকার ধারণ করে। আমি নৌকা প্রতীক পেলে আহম্মদরা আমার পক্ষে কাজ করে। অন্যদিকে মামুনরা স্বতন্ত্র প্রার্থী আক্তারুজ্জামান জীবনের পক্ষ হয়ে নির্বাচন করে। দুপক্ষেরই অন্তত ৩০টি মামলা আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ এলাকায় যাই ঘটুক মামুনের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো মামলা নেয় না। পুলিশের এক বড় কর্মকর্তা মামুনের বোন জামাই। যার জন্য সে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলেও তাকে মামলার আসামি করা হয় না।’
চেয়ারম্যান বলেন, ‘সবশেষ দুটি পক্ষকে নিয়ে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে মীমাংসার জন্য বসা হয়। সেখানে জীবন ও মামুনকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও তারা পরে আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।’
তবে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদ সদস্য আক্তারুজ্জামান জীবন বলেন, ‘এসব ঘটনার মীমাংসার জন্য আমরা সম্প্রতি জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে উভয়পক্ষকে নিয়ে বসি। সেখানে উভয়পক্ষ আর সহিংসতায় না জড়ানোর প্রতিজ্ঞা করে। এরপর থেকে এলাকায় সহিংসতা বন্ধ আছে।’
শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না, টিউবওয়েল খুলে নিয়ে গেছে, অনাবাদী জমিতে চাষাবাদ করতে পারছে না এমন সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি জীবনের।
জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্থ ও প্রশাসন) সুমন দেব বলেন, মামুন হাওলাদার কার আত্মীয় সেটি আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। পুলিশের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও আমাদের বলেনি তিনি কারও আত্মীয়। থানায় তার বিরুদ্ধে কেন মামলা হয় না সেটি এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে তিনি প্রকৃত অপরাধী হলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা নেওয়া হবে।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন