সরকারী বিধিনিষেধের থাবা: ঠাকুরগাঁওয়েও আম ব্যবসায় পচন
ঠাকুরগাঁও সংবাদাদাতা: উত্তরবঙ্গের কৃষিনির্ভর জেলা ঠাকুরগাঁও। রাজধানী থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরের সীমান্তবর্তী এই জেলায় নীরবে ঘটেছে কৃষি বিপ্লব। আম-কাঁঠালসহ নানা ধরনের ফলমূল ও শাকসবজির উৎপাদন হয় জেলার সর্বত্র। তবে চলমান লকডাউনে আশানুরূপ বিক্রি না হওয়ায় আমচাষিরা পড়েছেন বিপাকে। বাগানে আম পেকে ফেটে পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু ক্রেতা কম।
ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলার বিভিন্ন আম বাগান ঘুরে এ চিত্র চোখে পড়েছে। মেঠোপথ পেরিয়ে জেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরের গ্রাম ছোটুয়াপাড়া। সেখানকার রাস্তার দুই ধারে আমের বাগান। নানান জাতের আম ঝুলছে থোকায় থোকায়। চোখ জুড়ানো সবুজ বাগান অতিথিদের জন্য উপভোগ্য হলেও ব্যবসায়ীদের জন্য এখন তা চরম দুশ্চিন্তার। কারণ এই বাগানের আয়ের ওপরেই চাষি ও বাগান কর্মীদের পরিবার নির্ভরশীল। কিন্তু চলতি মৌসুমে আম পেকে গেলেও বিক্রি না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা।
কথা হয় বাগান লিজ নেয়া দিনাজপুরের ব্যবসায়ী আশরাফ আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, ২৫ বিঘা জমির ওপর ৪ হাজার আম গাছের বিশাল বাগান তার। হাড়িভাঙ্গা, মিশরিভোগ, আম্রপালি ও বারি ফোর- এই চার জাতের আম আছে সেখানে। গতবার এই বাগান থেকে ২ হাজার মণ আম বিক্রি হয়েছিল। এবার ফলন বেশি হয়েছে। আড়াই থেকে তিন হাজার মণ বিক্রির হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ক্রেতার অভাবে আম পেকে বাগানেই পড়ে যাচ্ছে।
এবার আম বিক্রি না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন আম কিনতে। তাদের আম নিয়ে যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা হলো লকডাউনের কারণে মানুষ বাজারে আসতে পারে না। মানুষ বাজার করতে পারছে না। যার কারণে আমের বাগানের আম বিক্রি হচ্ছে না। বয়স হয়ে বাগানেই পেকে ফেটে পড়ে যাচ্ছে আম।’
আশরাফ আরও বলেন, ‘গতবার ভালো দাম পেয়েছি। এবার ফলন বেশি, চাহিদা কম, দামও কম।’
‘সরকারের আমের প্রতি কোনো উদ্যোগই নেই। আম চাষিদের প্রতি তাদের কোনো নজর নেই। কৃষি বিভাগ খবরও নেয় না,’ অভিযোগ করেন এই ব্যবসায়ী।
আশরাফ আলীর ছেলে নুরুজ্জামান ইসলামও ব্যবসা করেন আমের। তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত ১৭০ মণ আম বিক্রি করেছি মাত্র। বাকি আম বিক্রি না থাকায় পেকে পড়ে যাচ্ছে। এজন্য কিছু ঘাটতিও আসছে। গতবার ২২শ’ টাকা ছিল আমের মণ। এবার ১২শ’ টাকা মণ যাচ্ছে। এই দামে আমাদের আসল (পুঁজি) টাকাই উঠবে না।’
নুরুজ্জামান বলেন, ‘দাম কমের কারণ হলো লকডাউন। জুনের ২৫-২৬ তারিখে আম পরিবহনের অনুমতি দেয়। এর কয়েকদিন পরই ১ তারিখ থেকে লকডাউন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আম্রপালির মাথার আম (বড় সাইজ) তুলি ১ তারিখের মধ্যে, বের হয়ে যায় ৮-১০ তারিখের মধ্যে। কিন্তু এখন ১২-১৩ তারিখ, কিন্তু আম তোলা শুরুই করতে পারিনি।’
নুরুজ্জামান বলেন, ‘চাহিদা কমে গেছে। মানুষ বাজারমুখী না হলে এই চাহিদা বাড়বে না। এ কারণে আম পেকে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে।’
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘১০ মণ পাকা আম দুই হাজার টাকায় বিক্রি করি। অথচ সময়মতো বিক্রি করলে সেটা ২০ হাজার টাকা হতো। এখানে ১৮ হাজার টাকা আমার লোকসান হবে।’
আম সংরক্ষণের কোনো উপায় আছে কি-না জানতে চাইলে এই তরুণ ব্যবসায়ী বলেন, ‘এই ক্যাপাসিটি আমাদের নেই। সরকার ব্যবস্থা করলে তো আমাদের সুবিধা হবে। যত দিন যাবে আমাদের দাম তত বাড়বে।’
এখানকার আমগুলোর মধ্যে দাম বেশি বারি ফোরের। গতবার এ আমটি বিক্রি হয়েছিল ৯ হাজার টাকা মণ দরে। এবার লকডাউনে চাহিদা না থাকায় এখনও বাগানেই রেখে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এভাবে কদিন রাখা যাবে সে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের মাথায়।
ব্যবসায়ী নুরুজ্জামান বলেন, ‘তিন লাখ টাকার আম বিক্রি করেছি। ন্যূনতম ২০ লক্ষ টাকার আম বিক্রি করলে আমার রক্ষা হবে। না হলে সব শেষ।’
তিনি বলেন, ‘জমির লিজের টাকা। পাশাপাশি শ্রমিকের মজুরি; আজকে ৩০ জন লোক ডিউটি করছে, প্রতিদিন ১০ জন কাজ করে, তাদের খরচ। সঙ্গে আমাদের খরচ। এসব তুলে নিজের ব্যবসা করতে হবে। কিন্তু যা দেখছি, তাতে তো কুল কিনারা পাচ্ছি না, কী করব?’
একই পরিস্থিতি চোখে পড়েছে ঠাকুরগাঁও সদরের পূর্ব নারগুন ইউনিয়নের শাপলা গ্রামের একটি আম বাগানে। স্থানীয় চাষি আবদুর রহমানের ৫ বিঘা জমির ওপর ১২৫টি আম গাছ। ব্যাপারী সাদেকুল ইসলাম ৫ বছরের জন্য লিজ নিয়েছেন। বছরে ১ লাখ টাকা করে দিতে হয়। পরিচর্যার জন্য তিনজন লোক আছে। মূলত চট্টগ্রামে আম পাঠান তারা।’
বাগানের তত্ত্বাবধায়ক আরিফ বিল্লাহ বলেন, ‘এখানে নতুন দুই জাতের আম আছে- বন্দিগুটি ও জামাইপচন। আমাদের আম তোলা শুরু করিনি। কোরবানির ঈদের পর তুলব। এখন লকডাউনে তো মানুষ বের হচ্ছে না। আম কিনছেও না। তাই চাহিদা নেই। আর চাহিদা না থাকায় দাম কমে গেছে। পাশাপাশি আম পড়ে আছে। পচনশীল পণ্য তো বেশিদিন রাখাও যায় না।’
তিনি বলেন, ‘গতবার ১৭৫ মণ আম হয়েছিল, এবার ফলন আরও ভালো হয়েছে। কিন্তু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্রেতা পাওয়া যায় না। পাশাপাশি দামও কমে গেছে।’
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন