প্রতি বছরেই বাড়ে বাজেট কিন্তু মরে না মশা
নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত আট মাসে সাত হাজারের বেশি মানুষ এই রােগে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ৩১ জন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে বছর বছর মশা নিধনে বরাদ্দ বাড়লেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি নেই।
কীটতত্ত্ববিদ এবং নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা নিধনে সিটি করপােরেশনের কোনো কার্যক্রমই কাজে আসছে না। এখন পুরো মশকনিধন কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। অথচ মশকনিধনের নামে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছেন তারা।
নাগরিকদের অভিযোগ, নগরের প্রতিটি বাসা-বাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্সের সঙ্গে মশা নিধনের ফি নেয় সিটি করপোরেশন। অথচ মশার যন্ত্রণা থেকে নাগরিকদের মুক্তি মিলছে না। এখন নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে বাসা-বাড়িতে লোকদেখানো অভিযান এবং জরিমানা করছে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের বৃহস্পতিবারের তথ্য বলছে, এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ২৭০ জন। এর মধ্যে ২৪০ জন রোগীই ঢাকা শহরের।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ২৫১ জন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন পাঁচ হাজার ৯৮২ জন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএনসিসি এবং ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের দুজন কর্মকর্তা জানান, মশা নিধনে কার্যকর পদ্ধতি সম্পর্কে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির কোনো গবেষণা নেই। ফলে মশা নিধনে তাদের কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। চলতি বছরের শুরুতে নগরে কিউলেক্স মশা বেড়েছিল চারগুণ। এখন এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তাদের প্রায় সবাই রাজধানীর বাসিন্দা।
গত বুধবার (১৮ আগস্ট) পুরান ঢাকার বংশালে এক অনুষ্ঠানে মশা নিধন নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তখন তিনি মশার উপদ্রব বাড়ার জন্য নাগরিকদেরই দায়ী করেছেন।
একই দিনে গুলশানের নগর ভবনে ‘সুস্থতার জন্য সামাজিক আন্দোলন’ বিষয়ক আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে সুস্থতার জন্য সামাজিক আন্দোলনকে আরও জোরদার করে ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে হবে।’
কিন্তু ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নিজেদের কতটা সক্ষমতা আছে, এ বিষয়ে তিনি কিছুই বলেননি।
পরে জানতে চাইলে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ডিএনসিসি এলাকায় এডিস মশা ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে মশকনিধনে কীটতত্ত্ববিদ দ্বারা পরীক্ষিত ও কার্যকর লার্ভিসাইড ছিটানো অব্যাহত রয়েছে। এডিস মশা বা ডেঙ্গু নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় কাউন্সিলরসহ ডিএনসিসির সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঠে সক্রিয় থাকার জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিটি করপোরেশন সাধারণত ডোবা ও নালায় জন্মানো মশা নিধনে ওষুধ ছিটায়। কিন্তু এডিস মশা নিজেদের বাসা-বাড়িতে ফুলের টব, অব্যবহৃত টায়ার, ডাবের খোসা, চিপসের খোলা প্যাকেট, বিভিন্ন ধরনের খোলাপাত্র, ছাদ কিংবা অন্য কোথাও, যেখানে তিন দিনের বেশি পানি জমে থাকে সেখানে জন্মায়। এদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।’
বাড্ডার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম। গত সোমবার (১৬ আগস্ট) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার বাড়ি বা আশপাশে এডিস মশা জম্মানোর মতো কোনো জায়গা নেই। সবকিছুই তিনি পরিষ্কার রাখেন। কিন্তু তারপরও তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন।
প্রতিবছরই বাজেট বাড়ে
গত পাঁচ বছরে মশা নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপােরেশনের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ডিএনসিসির বরাদ্দ বেড়েছে ১৪৫ দশমিক ২২ শতাংশ। গত অর্থবছরে সংস্থাটির বরাদ্দ ছিল ২২ কোটি টাকা। চলতি বছরে এই বাজেট আরও দুই কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। আর ডিএসসিসির বরাদ্দ বেড়েছে ১৬৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। পরের দুই বছরই এই সংখ্যা বেড়েছে। তারপরও ২০১৯ সালে ঢাকায় এক লাখ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছেন শতাধিক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু মৌসুম। ২০২০ সালের জুন ও জুলাই মাসের তুলনায় ২০২১ সালের এই দুই মাসে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে ৬০ গুণ। এখন আগস্টের হিসেব ধরলে সংক্রমণের সংখ্যা ৭০ গুণ ছাড়িয়ে যাবে। যদিও বছরের শুরুতেই ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক করেছিলেন কীটতত্ত্ববিদরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার মনে করেন, ‘শুধু বাজেট বাড়ালেই মশা নিধন হবে না। বরাদ্দের পুরাে ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা মহানগরে প্রতিনিয়ত লােকসংখ্যা বাড়ছে। তাই মশা নিধনে দুই সিটি করপােরেশনের কার্যক্রম এবং গবেষণা বাড়ানাে উচিত।’
তিনি বলেন, ‘যখন মশা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন উঠেপড়ে লাগেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অথচ এই প্রবণতা সারা বছরই তাদের থাকা উচিত।’
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন