পানিতে ভাসছে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর
নড়াইল সংবাদাদাতা: পানিতে ভাসছে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার। বিলের মধ্যে করা ঘরে দুইমাস ধরে পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে আশ্রয়ন প্রকল্পের ১৮টি পরিবার। অসহায় লোকগুলো ঘর উপহার পেয়েও ঠিকমতো বসবাস করতে পারছেন না। প্রকল্পের মধ্যে পানি উঠে পড়ায় পোকা-মাকড় ও সাপের ভয়ে দিনপার করছেন বাসিন্দারা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, খাস খতিয়ানভুক্ত এই জমি অপেক্ষাকৃত নিচু। এখন বর্ষা মৌসুমে আশেপাশের কৃষি জমিতে পানিতে জমে যাওয়ায় সেই পানি ঢুকে পড়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মধ্যে। ঘরগুলো নির্মাণের আগে প্রকল্পের জমি উঁচু করে নিলে কিংবা প্রকল্পের চারপাশে গাইড ওয়াল নির্মাণ হলে পানিবদ্ধতার এই সমস্যা দেখা দিতো না। আগেপিছু না ভেবে নিচু জমিতে ঘর নির্মাণ করায় বাসিন্দারা ভোগান্তিতে রয়েছেন।
নড়াইলের জেলা প্রশাসন হাবিবুর রহমান বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্ষা মৌসুমে পানি ঢুকে পড়বে বিষয়টি ওই সময় চিন্তাতে ছিল না।
প্রকল্প বাস্তবায়নে তড়িঘড়ি থাকায় বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা হয়নি বলে জেলা প্রশাসক স্বীকার করেন। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে যে বরাদ্দ ছিল, সেই বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন তদারকিতে ছিলেন কালিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হুদা। তিনি এখন বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক।
সরেজমিনে দেখা যায়, নড়াইলের কালিয়া উপজেলার চাচুড়ি ইউনিয়নের আটঘরিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়েছেন পাশের কালডাঙ্গা, বনগ্রাম, সরকেলডাঙ্গা,আরাজী বাসগ্রাম,আটঘরিয়া, কলিমন ও আটলিয়া গ্রামের বাস্তুহারা মানুষজন।
স্থায়ীভাবে পাকা ঘর এবং জমি পেয়ে হতদরিদ্রদের সবাই অত্যন্ত খুশি হয়ে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন। কিন্তু মাস না যেতেই সেই খুশির ঘরই এখন তাদের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে।
যশোরের নওয়াপাড়ায় একটি মিলে কাজ করতেন দিনমজুর মোস্তফা শেখ। স্ত্রী, ছেলে, পুত্রবধূ সব মিলিয়ে ভাড়ায় থেকে তিনি দিনাতিপাত করছিলেন। এলাকায় সরকার ঘর দিচ্ছে এই খবরে সব ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে ফিরে নতুন ঘরে ওঠেন। কিন্তু তার স্বপ্ন নষ্ট করে দিয়েছে বিলের পানি। গত দুইমাস ধরে হাঁটু পানিতে চলছে তার সংসার।
শুধু মোস্তফাই নয় আটঘরিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৮টি পরিবারের ৭০জন মানুষ দুইমাস ধরে দুর্বিসহ জীবন কাটাচ্ছে। পুরো আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো ভাসছে দুই ফুট পানিতে।
পাশের একটু উঁচু জায়গায় চুলা তৈরি করে সেখানে পালাক্রমে রান্না চলছে, বৃষ্টিতে তাও বন্ধ হয়ে যায়। প্রকল্পের ভেতরে ঢুকতে গেলে কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও বেশি। ঘরে ভেতর দিনরাত পানি সেচে চলেছেন নারীরা। ঘরের মধ্যে পাকা বাথরুমে হাঁটুপানি তাই রাতের বেলা এখানে-সেখানে সারতে হয় প্রাকৃতিক কাজ।
এটি দিনের চিত্র, রাতের অবস্থা আরও ভয়াবহ। বিদ্যুতের ব্যবস্থা এখনও হয়নি, তাই সন্ধ্যা হলেই ঘরের মধ্যে চৌকিতে সাপের ভয়ে বসে থাকেন নারীরা। ছোট শিশুদের পানিতে ডুবে যাওয়ার ভয়ে মায়েরা জেগেই রাত কাটাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নড়াইল জেলায় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের মোট ৪৭৭টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। কালিয়া উপজেলায় দুইধাপে আড়াই’শ ঘর প্রদান করেছে সরকার। চাচুড়ী বিলের মধ্যে অবস্থিত আটঘরিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে বছরের ৬ মাসই পানির মধ্যে থাকে। কুলসুর, নোয়গ্রাম সহ নবগঙ্গা নদীর চরে আরও অনেক আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দাদের একই দশা।
কালিয়া উপজেলায় সদ্য যোগদানকারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরিফুল ইসলাম বলেন, আমরা স্থায়ী সমাধানের কথা ভাবছি। গাইড ওয়াল নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবটি পাস হয়ে এলে শিগগিরই আমরা উদ্যোগ শুরু করব।
তিনি বলেন, ওই জমিতে খরচ নির্মাণের আগে বালি কিংবা মাটি ফেলে জায়গাটি আরও উঁচু করে নিতে ভালো হতো। খরচ যখন হয়েছে, আরেকটু বেশি খরচ হলে তো অসুবিধা ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ওখানে ড্রেজিং মেশিন বসিয়ে পানি শুষে নেওয়ার ব্যবস্থা করব। আজকের মধ্যেই এটির সমাধান করে ফেলব।’
বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, আমরা বিদ্যুৎ বিভাগকে বলেছি। এরইমধ্যে তারা প্রস্তুতি নিয়েছে। দুই একদিনের মধ্যে মিটার বসে যাবে। তখন আলো থাকলে ঘরের মধ্যে পোকা-মাকড় কিংবা সাপ ঢুকতে সাহস পাবে না।
প্রকল্পের মধ্যে পানি ঢুকলেও ঘরগুলোর কোনো ক্ষতি হয়নি বলে দাবি করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
আশ্রয়ণ প্রকল্প বিষয়ে জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পানিবদ্ধতার যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তা সাময়িক। পানি নেমে গেলে এই সমস্যা আর থাকবে না।’
তিনি বলেন, ‘প্লেস নির্ধারণে সমস্যা হয়েছে। ঘর নির্মাণের সময় জায়গাটি উঁচু করা হয়নি। তড়িঘড়ি ছিল।’
পানিবদ্ধতা বিষয়ে জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবিনি। তবে প্রকল্পের পেছনে যে বরাদ্দ ছিল সেই অনুযায়ী কাজ করা হয়েছে।’
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন