নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক, চলে না পরীক্ষা-নিরীক্ষার মেশিন
নীলফামারী সংবাদাদাতা: পাঁচ উপজেলায় সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। জানা যায় জেলা সদর, ডোমার, ডিমলা, কিশোরগঞ্জ, জলঢাকা হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৯২ জন চিকিৎসক পদের বিপরীতে কাজ করছেন মাত্র ৫২ জন। শূন্য রয়েছে ১৪০ পদ। এছাড়া পাঁচ উপজেলায় ৪৬৩ জন নার্সের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন ১৯৪ জন। কাগজপত্রে ৫৫৭ জন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থাকার কথা থাকলেও কর্মরত ২০৮ জন। চতুর্থ শ্রেণির ৩৫৭ জন কর্মীর বিপরীতে কাজ করছেন মাত্র ১০৭ জন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নীলফামারী ২৫০ শয্যা (জেনারেল) হাসপাতালে ৫৭ জন চিকিৎসকের বিপরীতে কাজ করছেন ১৬ জন। নার্স ১৪৯ জনের মধ্যে রয়েছেন ৯০ জন। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ১৬৫ জনের মধ্যে রয়েছেন ১১০ জন। চতুর্থ শ্রেণির ১২০ কর্মীর মধ্যে রয়েছেন ৫০ জন। রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ৩৯টি মেশিনের মধ্যে অচল ১৮টি। এতে স্বল্প খরচে সঠিক রোগ নির্ণয়ের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। পরীক্ষার জন্য যেতে হয় বেসরকারি ক্লিনিক বা ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে। এতে মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হয় রোগী ও স্বজনদের।
রোগী ও স্বজনেরা বলেন, হাসপাতালে রোগী এলে দালাল চক্রের দৌঁড়ঝাপ শুরু হয়। বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা করাতে চেষ্টা করেন তারা। কারণ বেসরকারি হাসপাতাল -ক্লিনিকে রোগী নিতে পারলেই তাদের ভাগ্যে জুটে কমিশনের টাক।
একই উপজেলার টুপামারী ইউনিয়নের রোগী মিলন মিয়া বলেন, আমার কোমড়ের ব্যাথা হাসপাতালে ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার পরীক্ষা দিয়ে বলেন বাইরে থেকে করিয়ে নিতে। আমি গরিব মানুষ, টাকা কোথায় পাবো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিভিল সার্জন কার্যালয়ের এক কর্মী বলেন, হাসপাতালে কমিশন বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসা চলছে। গর্ভবতী রোগী হাসপাতালে এলে ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য কর্মচারীদের যোগসাজসে দালালরা বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করে। সেখানে তারা কমিশন পায়, সেই কমিশন ভাগবাটোয়ারা হয়।
জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. আবু আল-হাজ্জাজ বলেন, দালাল চক্রের বিষয়টি আমার জানা নেই, আমি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেবো।
জেলার ডোমারে ৫০ শয্যা বশিষ্টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্েেলক্সে ৩১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে ১৮ জন চিকিৎসক দিয়ে চলছে চিকিৎসা সেবা। নার্স ৩১ পদের মধ্যে ত্রিশ জন রয়েছেন। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ৯৬ জনের মধ্যে রয়েছেন ৬০ জন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ৩৫ জনের মধ্যে রয়েছে ১৬ জন। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। তবে একযুগ ধরে হাসপাতালের আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন নষ্ট রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে- মেশিন নষ্ট থাকায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে ব্যক্তিগত চেম্বারে আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনে রোগীর পরীক্ষার পর ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রায়হান বারী।
ভুক্তভোগী জোড়াবাড়ী ইউনিয়নের বেতগাড়া গ্রামের রোগীর স্বজন রুমানা আক্তার বলেন, আমার বোন গোলাপি বেগম শরীর ফোলা নিয়ে ভর্তি ছিল। তবে ভালো মানের চিকিৎসা নেই ও পরীক্ষার জন্য আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন না থাকায় রোগী নিয়ে চলে যাচ্ছি রংপুরে।
এ বিষয়ে ডা. রায়হান বারী বলেন, আল্ট্রসনোগ্রাম মেশিন নষ্ট, বারবার ঠিক করলেও ঠিক হয় না। রোগীর চাহিদার কারণে আমি ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখি ও আল্ট্রাসনোগ্রাম করি।
এদিকে ডিমলায় ৫০ শয্যা বশিষ্টি উপজলো স্বাস্থ্য কমপ্লক্সে কাগজপত্রে ১৪ জন চিকিৎসকের জায়গায় ছয় জন চিকিৎসক কাজ করছেন। নার্স ৩৫ জনের মধ্যে রয়েছেন ২৩ জন। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ২৬ জনের মধ্যে রয়েছেন ১০ জন। চর্তুথ শ্রেণির ২৮ জনের মধ্যে রয়েছেন ১০ জন। সার্জারি, অ্যানেস্থেসিয়া ও গাইনি ডাক্তার না থাকায় অপারশেন থিয়েটার বন্ধ রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় রোগীর স্বজন বালাপাড়া ইউনিয়নের আব্দুল হামিদ ও রোকসানা বেগমের সঙ্গে। তারা বলেন, আমাদের দুঃখের কথা কাকে বলবো। হাসপাতাল অনিয়মে ভর্তি। চিকিৎসা করবার এলে বলে পরীক্ষা নাই, চিকিৎসা নাই। শুধু রংপুর হাসপাতাল বা ক্লিনিকে রোগী পাঠিয়ে দিতে চায়। এখানে চিকিৎসার অভাবে অনেক রোগী মরে যাচ্ছে।
উপজলো স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সারোয়ার আলম বলেন, অনিয়মের বিষয়ে আমার জানা নেই। ব্যাপক জনবল ঘাটতরি কারণে চিকিৎসায় হিমশিম খেতে হয়।
কিশোরগঞ্জ উপজেলার ৫০ শয্যা হাসপাতালেও রয়েছে জনবল সংকট। সীমিত জনবলে চলছে স্বাস্থ্যসেবা। ২০ জন চিকিৎসকের মধ্যে হাসপাতালে আছেন মাত্র ছয় জন। নার্স ২৪ জনের মধ্যে আছেন ২৩ জন। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ৩০ জনের মধ্যে রয়েছেন ১৫ জন। চতুর্থ শ্রেণির ৩৩ জনের মধ্যে রয়েছেন ১৪ জন। অপারেশন থিয়েটার চালু নেই, রোগ পরীক্ষার জন্য এক্সরে মেশিন, আল্ট্রাসনোগ্রামসহ অন্যান্য মেশিন থাকলেও নেই টেকনিশিয়ান। পরীক্ষার রোগীদের যেতে হয় বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে।
ভুক্তভোগী রোগীর স্বজন পুটিমারী ইউনিয়নের মিজানুর রহমান বলেন, দুইদিন থেকে বুকে ব্যথা। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার দেখানোর পর পরীক্ষার জন্য বাইরে পাঠায়। সেখানে ১২০০ টাকায় পরীক্ষা করি। সবমিলে মনে হচ্ছে ভোগান্তির আরেক নাম কিশোরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু শফি মাহমুদ বলেন, জনবল সংকটের কারণে রোগ নির্ণয়ের মেশিন চালু করা যাচ্ছে না। তাই চিকিৎসা দিতে সমস্যা হচ্ছে।
জনবল সংকটের চিত্র দেখা যায় জলঢাকা ৫০ শয্যা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। হাসপাতালে ১৮ জন চিকিৎসকের বিপরীতে আছেন ছয় জন। নার্স ৩০ জনের মধ্যে রয়েছেন ২৮ জন। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ৩২ জনের মধ্যে রয়েছেন ১৩ জন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ৩৪ জনের মধ্যে রয়েছেন ১৭ জন। এক্সরে, আল্ট্রাসনোগ্রাম অন্যান্য পরীক্ষার মেশিন থাকলেও টেকনিশিয়ান ও চিকিৎসক না থাকায় এসব সেবা থেকে বঞ্চিত রোগিরা। যে কোনও রোগী এলেই বেসরকারি ডায়াগনোস্টিক সেন্টার অথবা ডাক্তারের ব্যক্তিগত চেম্বারে পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে গেলে কথা হয় খুটামারা ইউনিয়নের রোগী স্বপ্না রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, জ্বর ও পেট ব্যথা নিয়ে দুইদিন থেকে চিকিৎসা নিচ্ছি, কোনও ফল নেই। রোগী এলেই পাঠানো হয় রংপুর হাসপাতাল বা বেসরকারি ক্লিনিকে। মোটা টাকা দিয়ে বাইরে অন্য কোথাও পরীক্ষা করতে হয়। দালালের খপ্পরে পরে রোগীর স্বজনেরা রোগীকে নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে দৌঁড়ঝাপ করেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এএইচএম রেজওয়ানুল কবীর বলেন, এখানে অপারেশনের কোনও ব্যবস্থা নেই। পরীক্ষার মেশিন থাকলেও টেকনিশিয়ান ও রেডিওগ্রাফারের অভাবে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন