করােনার সনদ প্রতারণা: রিপোর্ট পজিটিভ বানিয়ে অর্থ আদায়
নিজস্ব প্রতিবেদক: এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাস পরীক্ষার সনদ প্রতারণা চলছিল রাজশাহী নগরীতে। এই ঘটনায় যুক্ত খোদ সিভিল সার্জন দফতরের কর্মী। কিন্তু বিষয়টি টেরই পাননি কর্তারা।
অবশেষে নগর গোয়েন্দা পুলিশের জালে আটকা পড়েছেন তারেক আহসান ওরফে আপেল (৩৫) নামের সিভিল সার্জন দফতরের ওই কর্মী। তিনি কর্মরত ছিলেন অফিস সহায়ক পদে। আপেল নগরীর কাটাখালী থানার কাপাসিয়া এলাকার আহসান উল্লাহর ছেলে।
এই ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন তার সহযোগী নগরীর বোয়ালিয়া থানার হেতেমখাঁ লিচুবাগান ওয়াবদা কলোনির আশরাফুল ইসলামের ছেলে রফিকুল ইসলাম (৪০) ও তার স্ত্রী সামসুন্নাহার শিখা (৩৫)। গ্রেফতার রফিকুল রাজশাহী বক্ষব্যাধি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক।
বুধবার (৭ জুলাই) রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাড়ি থেকে স্ত্রীসহ গ্রেফতার হন রফিকুল ইসলাম। আর বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) বেলা ১১টার দিকে নগরীর জাদুঘরের মোড়ে এলাকার বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের সামনে থেকে গ্রেফতার হন আপেল।
তারা বক্ষব্যাধি ক্লিনিককেন্দ্রিক পিপিআই সেন্টারে করোনা পরীক্ষার প্রতিবেদন নিয়ে বিদেশগামীসহ অন্যদের সঙ্গে প্রতারণা করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিলেন। অভিযানে তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ১০০টি করোনা পরীক্ষার সনদের জাল কপি।
পুলিশ জানাচ্ছে, এই চক্রের আরও দুজন সদস্য পালিয়ে গেছেন। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। চক্রে সিভিল সার্জন দফতরের আরও কেউ জড়িত আছে কি না তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
এদিকে, বৃহস্পতিবার দুপুরের দিন নিজ কার্যালয়ে অভিযানের আদ্যপান্ত সাংবাদিকদের জানান মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার উপপুলিশ কমিশনার মাে. আরেফিন জুয়েল।
তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে জানায়, বিদেশগামীরা করোনা পরীক্ষায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী সদর হাসপাতাল ও বক্ষব্যাধি হাসপাতাল এবং সিভিল সার্জন অফিসে স্যাম্পল জমা দেন। এদের অনেকেরই ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে করোনা পরীক্ষার সনদ প্রয়োজন পড়ে।
এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে করোনা পরীক্ষার নমুনা প্রদানের ফরম থেকে মোবাইল নম্বর ও নাম ঠিকানা সংগ্রহ করে চক্রটি। সেই সঙ্গে তারা অফিসের পিয়ন বা কম্পিউটার অপারেটরের মাধ্যমে করোনার নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টের কপি সংগ্রহ করতেন।
রিপোর্ট নেগেটিভ সত্ত্বেও চক্রের সদস্যরা বিদেশগামীদের ফোনের মাধ্যমে জানাতেন, করোনা রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। রিপোর্ট নেগেটিভ দেওয়ার শর্তে অর্থ দাবি করতেন চক্রের সদস্যরা। সেক্ষেত্রে বিদেশগামীদের অবস্থা বুঝে ৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করতেন তারা।
এই নগর পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি সিভিল সার্জন অফিসকেন্দ্রিক একটি চক্র করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে প্রতারণা করছে। তাদের প্রধান টার্গেট ছিল বিদেশগামীরা। এর বাইরেও যারা নিয়মিত নমুনা পরীক্ষা করাতেন, তাদেরও একই কায়দায় জিম্মি করছিল চক্রটি। এইভাবে চার মাস ধরে চক্রটি অসহায় মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
ডিবি এই কর্মকর্তা আরও বলেন, এরই মধ্যে চক্রের হোতা ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য দুজন পলাতক রয়েছেন। ওই চক্রের সদস্য রফিকুল ইসলাম সিভিল সার্জন দফতর থেকে তথ্য নিয়ে গিয়ে স্ত্রীকে দিতেন।
এরপর ওই নারী সেই তালিকা ধরে লোকজনকে ফোন দিতেন। বিকাশ নম্বর দিয়ে চাহিদামতো রিপোর্ট দেওয়ার শর্তে অর্থ আদায় করতেন। কিন্তু তারা রিপোর্ট বদলাতেন না। মাঝখানে প্রতারণা করে অর্থ হানিয়ে নিতেন। ওই নারী এমন প্রতারণার মাধ্যমে ২ হাজার ২৫ জনের কাছে অর্থ আদায়ের কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
চক্রে সিভিল সার্জন দফতরের আরও কেউ জড়িত আছে কি না এমন প্রশ্নে এই গোয়েন্দা কর্তা বলেন, চক্রটি যে কৌশলে কাজ করতো তাতে মনে হয়েছে, সিভিল সার্জন দফতরের আরও কেউ এতে যুক্ত। কিন্তু তাদের আমরা খুঁজে বের করব।
তবে সেখানে যারা দালাল হিসেবে পরিচিত তাদের সম্পৃক্তার তার তথ্য পেয়েছি। একে একে চক্রের সবাই গ্রেফতার হবে। এ ঘটনায় বােয়ালিয়া মডেল থানায় একটি নিয়মিত মামলা দায়ের করার প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান ডিবির এই কর্মকর্তা।
রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, ঘটনাটি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। যারা এই ঘটনায় জড়িত তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনত ব্যবস্থা নেবে। পুলিশই খুঁজে বের করে এই চক্রে আর কারা জড়িত।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন