যেভাবে ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ
নিউজ ডেস্ক: সম্প্রতি ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দাবি করেছে, ভারত যদি নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দেয় তাহলে অর্ধেক বাংলাদেশ খালি হয়ে যাবে, এ অর্ধেক বাংলাদেশি ভারত চলে আসবে। তার এমন মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছে ভারতের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, টিভি উপস্থাপক ও লেখক করণ থাপর। এক নিবন্ধে সে তুলে ধরেছে অর্থনৈতিক, জীবনমানসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
সিএনএন-আইবিএন ও ইন্ডিয়া টুডের সঙ্গে। বর্তমানে সে দ্য ওয়ারের সঙ্গে যুক্ত আছে। সে দ্য ডেভিলস অ্যাডভোকেট দ্য আনটোল্ড স্টোরি বইয়ের লেখক। শনিবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘হিন্দুস্তান টাইমস’এ প্রকাশিত তার লেখাটি তুলে ধরা হলো :
সত্যি কথা বলতে আমি হেনরি কিসিঞ্জারকে দায়ী করি। ’৭০-এর দশকে দিকে তিনি বাংলাদেশকে ‘আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। সন্দেহ নেই, ওই সময় দেশটি তা ছিল। টেলিভিশনে প্রচারিত ধারাবাহিক ফুটেজে বারবার ভয়াবহ বন্যায় দেশটির এ চরিত্র নিশ্চিত করেছে। ফলে কিসিঞ্জারের ওই বর্ণনা টিকে যায়।
এখন বাংলাদেশ একটি ভিন্ন দেশ। দেশটির বিষয়ে বিশে্বর অভিমত হয়তো খুব ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে। যদিও আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত নই। কিন্তু ভারতে আমাদের ১৯৭০-এর দশকে আটকে থাকার কোনো মানে হয় না। তারপরও গত সপ্তাহে ভারতের এক প্রতিমন্ত্রী যা বলেছে তাতে সেটাই স্পষ্ট হয়।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডি বলেছে, ‘ভারত যদি নাগরিকত্বের প্রস্তাব দেয় তাহলে অর্ধেক বাংলাদেশ খালি হয়ে যাবে। নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলে অর্ধেক বাংলাদেশি ভারতে চলে আসবে।’ ক‚টনৈতিক শিষ্টাচার ও আক্রমণাত্মক মন্তব্যের কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশের সত্যিকার অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। আরও খারাপ হলো, সে জানে না, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে ভালো করছে, বিশেষ করে জীবনযাপনের মানের ক্ষেত্রে।
প্রথমত, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি যে হারে আগাচ্ছে তাতে আমরা ভারতে শুধু হিংসা এবং আগামী দুই বা তিন বছরের মধ্যে তা অর্জন করার আশা করতে পারি। আমরা রয়েছি ৫ শতাংশের নিচে, আর বাংলাদেশ ৮ শতাংশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, নির্মলা সীতারমন চীনা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ১৫ শতাংশ করপোরেট করের প্রস্তাব দিয়ে মরিয়া চেষ্টা করছে। কিন্তু বাংলাদেশ হলো সেই দুটি দেশের একটি, যেখানে চীনা বিনিয়োগ যাচ্ছে। এর ফলে লন্ডন ও নিউইয়র্কের সড়কের পাশের দোকানগুলো বাংলাদেশে তৈরি পোশাকে ভরে গেছে। কিন্তু খুব কমই আছে লুধিয়ানা ও ত্রিপুরায় উৎপাদিত পোশাক। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, বাংলাদেশের পোশাক রফতানি ২০১৯ অর্থবছরে দ্বিগুণ হয়েছে, ভারতের কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
যাই হোক, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ভারত ও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির একটা অংশ মাত্র। অন্য পার্থক্যের কথা আরও বিশাল। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের জীবনযাপন অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলেই দৃশ্যমান।
তথ্যের দিকে নজর দিয়ে দেখুন। বাংলাদেশে পুরুষ ও নারীদের সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল যথাক্রমে ৭১ ও ৭৪ বছর। ভারতে হলো ৬৭ ও ৭০ বছর। এ বড় বিষয়টির দিকে যখন তাকাবেন তখন পার্থক্য আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে।
প্রথমত, শিশুদের কথাই ধরুন। ভারতের নবজাতকের মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২২ দশমিক ৭৩ শতাংশ; বাংলাদেশে তা ১৭ দশমিক ১২ শতাংশ। শিশু মৃত্যু হার ভারতে ২৯ দশমিক ৯৪ আর বাংলাদেশে ২৫ দশমিক ১৪। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর মৃত্যু হার আমাদের ৩৮ দশমিক ৬৯ এবং সেখানে ৩০ দশমিক ১৬।
এবার আসুন নারীদের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি নারীদের ৭১ শতাংশ স্বাক্ষর। আর ভারতে তা ৬৬ শতাংশ। বাংলাদেশে শ্রমে নারীদের অংশগ্রহণ ৩০ শতাংশ ও তা বাড়ছে। আমাদের ২৩ শতাংশ এবং গত দশকে তা কমেছে ৮ শতাংশ।
সবশেষে দেখুন উচ্চ বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের ভর্তির অনুপাত। যে সূচক ইঙ্গিত দেয় ভবিষ্যৎ উন্নয়নের। ভারতে এ অনুপাত শূন্য দশমিক ৯৪ কিন্তু বাংলাদেশে ১ দশমিক ১৪। সীমান্তের ওপারের অবস্থা শুধু যে ভালো তা নয়, তারা আরও ভালোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরাই পিছিয়ে পড়ছি।
ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন যখন বলেন, ‘অর্থনৈতিক কারণে কিছু ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন’, তিনি হয়তো সঠিক কথাই বলেছেন। মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায় নিজেদের জীবনমানের উন্নতি করতে এবং বাংলাদেশের জীবনযাপন নিশ্চিতভাবেই আরও ভালো বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আপনি যদি গরুর মাংস বিক্রির জন্য গণপিটুনির আতঙ্কে থাকা একজন ভারতীয় মুসলিম হন, হিন্দু নারীর প্রেমে পড়ায় ‘লাভ-জিহাদে’ অভিযুক্ত হন অথবা নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে থাকেন, তাহলে সহজেই সীমান্ত পার হয়ে ওপারে চলে যেতে প্রলুব্ধ হতে পারেন।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসার মতো প্রবণতা খুব বেশি নেই। যে পরিসংখ্যান আমি উদ্ধৃত করেছি তাতে দেখা যাচ্ছে ভারতের বৈধ নাগরিক হওয়ার চেয়ে বাংলাদেশে কীট হওয়া বেশি আকর্ষণীয়।
শেষ একটি কথা, রেড্ডিকে কারও এ কথা মনে করিয়ে দেওয়া উচিত, যুক্তরাষ্ট্র যদি নাগরিকত্বের প্রতিশ্রæতি দেয় তাহলে অর্ধেক ভারত খালি হয়ে যাবে। সত্যিকার অর্থে তা আরও বেশি হবে। সে যাই হোক, ঘটনা হলো এখন যুক্তরাষ্ট্রের দরজা বন্ধ রয়েছে কিন্তু তাতে করে আমাদের ঠেকানো যাচ্ছে না।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন