মুসলিম সমাজে বাংলা ভাষাশিক্ষার অগ্রদূত :ফুরফুরা শরিফের দাদা হুজুর
আগেই বলেছি , কাছাকাছি শহরের ব্যস্ততা কোলাহল কিছুই এ জনপদকে স্পর্শ করে না৷ সতত এখানে শান্ত হাওয়া বইছে৷ জাঁকজমক আনন্দ এখানে চিরস্থায়ী৷ আপাত জৌলুস নেই, যা আছে তা মনের প্রশান্তি , প্রাণের আরাম ও আত্মার শান্তি৷ আর গতি তো এখানে চিরকাল৷ তাই শুধু মুসলমান সমাজে নয় , সমাজের সর্বস্তরের লোকেদের কাছে ফুরফুরার গুরুত্ব অপরিসীম৷ লোক বিশ্বাস , ইতিহাসও মেনে নেয় এ অঞ্চল থেকেই অখণ্ড বাংলা , আসাম , বিহার সর্বত্র ইসলাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল৷ সেই ইসলাম , রাজনৈতিক ইসলাম নয় , সমাজ সংস্কারের ভূমিকায় সর্বধর্মসমন্বয়ের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷ আমেরিকার সমাজবিজ্ঞানী টনি স্টুয়ার্ডের কথায় — ইসলামের শান্তির বাণী প্রচারে ফুরফুরার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷
সত্যি কথা বলতে কী , ফুরফুরা শরিফের ইতিহাস , তার গুরুত্ব, সমাজসংস্কারে তার ভূমিকা এখনও সে ভাবে প্রচারে আসে না৷
অথচ নানা কারণে সমাজে এখন যে অসহিষ্ণু পরিবেশ তৈরি হচ্ছে , তার সমাধানে এই অজানা অচেনা ইতিহাস সামনে আসা দরকার৷ বস্ত্তত ফুরফুরার সঙ্গে আমার পরিচয়ও বেশি দিনের নয়৷ কয়েক মাস আগে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পির আবু বকর সিদ্দিকি মেমোরিয়াল কমিটি দক্ষিণ এশিয়ায় সমাজ সংস্কারে সিদ্দিকি সাহেবের ভূমিকা নিয়ে যে আন্তর্জাতিক সেমিনার করেছিল , সেখানে সুইডেনের মার্গারেট হান্ট , আমেরিকার টনি স্টুয়ার্ড, সুগত বসু, তনিকা সরকারদের কথা শুনতে শুনতে ইতিহাসের এক অত্যাশ্চর্য জগতের কথা জানতে পারলাম৷ কলকাতার কাছে হুগলির জাঙ্গিপাড়ার এই আরশিনগর তখন থেকে আমার আগ্রহের বিষয়৷
ফুরফুরা জনপদের নানা আখ্যান নিয়ে পরে কথা হবে৷ তবে তার আগে যাঁকে নিয়ে দেশবিদেশের পণ্ডিতেরা এত উসিত , সেই মোজাদ্দিদেজামান বা যুগসংস্কারক হজরত আবু বকর সিদ্দিকি , যিনি সর্বত্র পরিচিত দাদা হুজুর নামে , তাঁর সম্পর্কে দু’চার কথা বলে নিই৷ আজ থেকে ১৭১ বছর আগে তিনি জন্মেছিলেন৷
বই পড়া বা জ্ঞানান্বেষণে আমৃত্যু দাদা হুজুরের আগ্রহ ছিল৷ হজরত মহম্মদের একটি কথা দাদা হুজুরও মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন , সবাইকে বলতেন যে, শিক্ষার জন্য , জ্ঞানের জন্যে চিন দেশ অবধি যাওয়া যেতে পারো৷ অর্থাত্ লেখাপড়ার জন্যে দুর্গম সব পথেই যাওয়া প্রয়োজন৷ হজরত আবু বকর সিদ্দিকি চেয়েছিলেন মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে৷ চাইতেন সাধারণ মুসলমানেরা ধর্মের পাশাপাশি রাজনৈতিক ভাবেও সচেতন হোক৷ যাবতীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সতত সোচ্চার ছিলেন দাদা হুজুর৷
দাদা হুজুর যে সময়ে সমাজ সংস্কারে ব্রতী হয়েছিলেন , সে সময়টা , উনিশ শতকের শেষার্ধ নিঃসন্দেহে মুসলমানদের কাছে ছিল অন্ধকার সময়৷ ওয়াহাবি , ফরাজি আন্দোলনের তীব্রতা প্রায় নেই৷ রাজনৈতিক ক্ষমতা ও নীতি নির্ণায়ক ভূমিকায় ইংরেজদের সে সময় প্রবল দাপট৷ হিন্দু সমাজের রেনেসাঁর আলো গ্রামবাংলায় সে ভাবে না আসলেও সমাজ -রাজনীতিতে তাদের সক্রিয় ভূমিকা স্পষ্ট৷ কংগ্রেস নেতৃত্ব জাতীয় আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা নিচ্ছে৷
ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের যুগসন্ধিক্ষণে , মুসলিম রেনেসাঁর অন্যতম বর্ণময় ব্যক্তিত্ব দাদা হুজুরের সম্ভবত সমাজে সবচেয়ে বড়ো অবদান বাংলা ভাষা -সাহিত্যের উন্নতি৷ ঠিক এটুকু বলাই বোধ হয় পুরোপুরি সঠিক বলা হবে না৷ বস্ত্তত অবিভক্ত বাংলায় লাখ লাখ মুসলমানের মধ্যে বাংলা প্রসারে বিরাট ভূমিকা ছিল দাদা হুজুরের৷
এই ভ্রান্ত ধারণার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন আবু বকর সিদ্দিকি৷ তিনি জানতেন , মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে কোনও জাতি কোনও দিন উন্নতি করতে পারে না৷ এও বুঝেছিলেন গ্রামের কৃষক , জেলে , ছোটো দোকানি কারও কাছে কোনও শিক্ষাই পৌঁছবে না , বাংলা ভাষা ছাড়া৷ তাই গোঁড়ামি বর্জন করে সে যুগে মুসলমান সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসতে উনি বেছে নিয়েছিলেন মাতৃভাষা৷ শুধু ভাষা নয় , তাঁর সক্রিয় প্রেরণাতেই তখন প্রসার লাভ করেছিল নানা পত্রপত্রিকা৷ ‘সোলতান ’, ‘মোহম্মদি মোসলেম ভারত ’, ‘মোসলেম দর্পণ ’, ‘শিখা সওগাত ’ এ রকম অজস্র পত্রিকার পিছনে ছিল দাদা হুজুরের প্রবল উত্সাহ , প্রেরণা৷ সে সময়ে সব রকম ভাষা সাহিত্য শিক্ষা আন্দোলনে আবু বকর সিদ্দিকি সাহেবের ছিল প্রাণের যোগ৷
দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা ছিল দাদা হুজুরের৷ খিলাফত্ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন৷ কিন্ত্ত ওঁর ভাবনাচিন্তাই ছিল জাতির উন্নতির কথা ভেবে৷ আজকের বামন অবতারদের মাঝে ওঁকে মস্ত উঁচু লাগে৷ অদ্ভুত ভালোবাসা ছিল গ্রামের গরিবস্য গরিবদের প্রতি৷ সেখানে কোনও হিন্দু মুসলমান ভাগ ছিল না৷ স্বাস্থ্য কেন্দ্র করলেন আধুনিক চিকিত্সার জন্যে৷ তা উদ্বোধন করতে ডাকলেন তখনকার স্বাস্থ্য আধিকারিক চ্যাটার্জী সাহেবকে৷ পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজকে কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় উনি জাগিয়ে তুলেছিলেন তা ভাবলে আজ এখন বিস্মিত হতে হয়৷ নিউ মার্কেটের কাছে এক পুরনো মসজিদে ওঁর দেখা হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে৷ গান্ধীজি তখন বিলিতি জিনিস বয়কটের ডাক দিয়েছেন৷ দাদা হুজুরের সঙ্গে ছিলেন শওকত্ আলি , মহম্মদ আলি , আবুল কালাম আজাদ৷ গান্ধীজি সবাইকে স্বদেশি সংগ্রামের তাত্পর্য বোঝাচ্ছেন , দাদা হুজুর বলে বসলেন — আপনার সঙ্গে আমি একমত নই৷ বিলিতি দ্রব্য বর্জনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গ্রাম বাংলার বিপুল সংখ্যক গরিব মুসলমান কারিগর৷ কী আশ্চর্য! ঠিক একই কথা তো রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ‘ঘরে বাইরে ’ উপন্যাসে নিখিলেশকে দিয়ে বলিয়েছিলেন৷
‘র্যাডিকাল থিওলজি ’-র যে ভাবনা আমরা লাতিন আমেরিকায় দেখতে পাই , বা উপমহাদেশে মৌলানা ভাসানির ভূমিকা — দুইয়ের সাদৃশ্যে ১৭০ বছর আগে বাংলা পেয়েছিল দাদা হুজুরের মধ্যে৷ ধর্মপ্রচারক , কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার , বাংলা ভাষা সাহিত্যের বড়ো সমর্থক, ইংরেজি শিক্ষায় আগ্রহী আধুনিক চিকিত্সা বিজ্ঞানের পক্ষে দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছেন , ইসলামের আসাউফ বা আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী , হিন্দু মুসলমানের ঐক্যের দূত৷ সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত লিখেছেন — ‘দাদা হুজুর আবু বকর সিদ্দিকি ছিলেন মুসলিম বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত৷ যিনি প্রকৃত অর্থে ছিলেন সমাজ সংস্কারক৷ বাংলা রেনেসাঁর সার্থক উত্তরসূরি৷ ’
বাংলাদেশের গবেষক ড . ওকিল আহমেদ সাহেব লিখেছেন — ‘ফুরফুরার পির সাহেবের সমাজে গভীর প্রভাব ছিল৷ ’ ডা . আনিসুজ্জামান পরম শ্রদ্ধায় লেখকদের সঙ্গে দাদা হুজুরের গভীর ভালোবাসার কথা জানিয়েছেন৷ এ হেন সর্বধর্মের জনগণের প্রিয় দাদা হুজুর মারা যান ১৯৩৯ সালে৷ তাঁর স্বপ্নের স্বাধীনতা তখনও আট বছর দেরি৷ হয়তো প্রিয় বাংলা ভাগ দেখতে হবে না বলেই তার আগেই চলে গেলেন যুগের সংস্কারক দাদা হুজুর হজরত আবু বকর সিদ্দিকি৷ কিন্ত্ত বাংলার ইতিহাসে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের দূত হয়ে তিনি থেকে যাবেন৷ eisamay.indiatimes.com
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন