দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতারদের অর্ধেকই সরকারি চাকরিজীবী
নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে দুর্নীতি মামলায় ৭৫০ জনকে গ্রেফতার করে দুদক, যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি সরকারি চাকরিজীবী। এই সময় ৩৬৪ জন সরকারি চাকরিজীবীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুদকের ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
২০১৯ সালে দুর্নীতি মামলায় ৮৪ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতার করে দুদক। একই বছর ২০ জন ব্যাংক কর্মকর্তা, তিনজন জনপ্রতিনিধি, ১৫ জন ব্যবসায়ী ও একজন অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৯ সালে দুর্নীতি মামলায় মোট ১২৩ জনকে গ্রেফতার করে দুদক।
আমলাতন্ত্রের সংস্কার না হলে কখনোই দুর্নীতি কমবে না। এ জন্য সিভিল সার্ভিস সংস্কার কমিশন গঠনের সুপারিশ দেয়া হয়েছে দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালে ১৪ জন ব্যাংক কর্মকর্তা, ২৮ জন সরকারি কর্মকর্তা, ১২ জন ব্যবসায়ী, একজন জনপ্রতিনিধি ও দুজন অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ মোট ৫৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তার আগের বছর ২০১৭ সালে দুর্নীতি মামলায় ২৫ জন ব্যাংক কর্মকর্তা, ৮৪ জন সরকারিজীবী, ৫০ জন ব্যবসায়ী, ১৩ জন জনপ্রতিনিধি ও ১০ জন অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ মোট ১৮২ জনকে গ্রেফতার করে দুদক। ২০১৬ সালে দুর্নীতি মামলায় ৮৭ জন ব্যাংক কর্মকর্তা, ১৬৮ জন সরকারি কর্মকর্তা, ১১২ জন ব্যবসায়ী, ১৩ জন জনপ্রতিনিধি ও আটজন অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ মোট ৩৮৮ জনকে গ্রেফতার করে দুদক।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকারিতা দেখাতে পারছে না। তেমনি নিয়ম পদ্ধতিগত ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। মানে, কেউ অন্যায় করলে দ্রুত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেয়ার কথা; সেটা হচ্ছে না। এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রিত ও নির্দেশিত অনেক ক্ষেত্রেই। সিস্টেমের যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে কোনো লাভ হবে না।’
সরকারি চাকরিজীবীদের দুর্নীতির বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেও একই চিত্র দেখা গেছে। ছোট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, বড় কর্মকর্তারা অধরাই থেকে যাচ্ছেন। এখানে পরিবর্তন হওয়া দরকার। যদি সত্যিকার অর্থে আমরা দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে চাই, তাহলে এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার।’
দুদক ছোট দুর্নীতি ধরে বড় দুর্নীতি আড়াল করে- এমন অভিযোগ করে ড. বদিউল আলম বলেন, দুদকের বিরুদ্ধে বহুদিন ধরে একটা অভিযোগ আছে, বলতে পারেন একটা অসন্তোষ আছে; দুদক চুনোপুঁটিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। অধরাই থেকে যায় রাঘববোয়ালরা। এটার প্রতিফলন তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়। আমাদের দেশে মেগা দুর্নীতি হচ্ছে। যেখানে সরকারি কমকর্তা, রাজনীতি ও ব্যবসায়ীরা জড়িত। ছোটখাটো যারা সামনে পড়ছে দুদক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু যারা নেপথ্যে থেকে এ ধরনের দুর্নীতি করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এটার একটা বিহিত হওয়া দরকার।’
তিনি বলেন, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক লুটপাট হচ্ছে। গণমাধ্যমে আমরা সে খবর দেখছি। বাংলাদেশ ব্যাংক, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বা তদন্ত করার কোনো উদ্যোগ আমরা দেখছি না। দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন থেকে মুক্তি চাইলে দুদককে আরও বেশি কার্যকর হতে হবে।’
২০১৯ সালে দুর্নীতির মোট ২১ হাজার ৩৭১টি অভিযোগ পায় দুদক। এসব অভিযোগের মধ্যে দুদক ৩ হাজার ৬২৭টির বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিভাগে অভিযোগ পাঠিয়েছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে ৩৬৩টি মামলা করেছে সংস্থাটি। ওই বছর ৬৩% ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পেরেছে বলে জানিয়েছে দুদক।
এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সুশাসন নিশ্চিতে দুদক ২০১৭ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ২৫টি টিম গঠন করেছে। এই টিম সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এবং কমিশনের বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে সুপারিশমালা প্রণয়ন করে। ২০১৯ সালে দুদকের ৮টি টিমের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে।’
দুর্নীতি বন্ধে আমলাতন্ত্রের সংস্কার চায় দুদক:
সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি প্রতিরোধে ও সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি থেকে দূরে রাখতে প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনো আমলাতন্ত্রের সংস্কার চায় দুদক। গত ৭ ফেব্রুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান সংস্থাটির ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করেন। সেখানে সেবাধর্মী ১৩টি খাতের দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত ও প্রতিরোধে করণীয় এবং এর পাশাপাশি সিভিল সার্ভিস সংস্কারের সুপারিশ দেয়।
এ প্রসঙ্গে ইকবাল মাহমুদ বলেন, আমলাতন্ত্রের সংস্কার না হলে কখনোই দুর্নীতি কমবে না। এ জন্য সিভিল সার্ভিস সংস্কার কমিশন গঠনের সুপারিশ দেয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জনসাধারণের বৃহত্তর কল্যাণে আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণমূলক নিয়ম-কানুনের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে সিভিল সার্ভিস সংস্কার করা দরকার।
সেবাধর্মী, কার্যকর এবং ব্যয়সাশ্রয়ী সিভিল সার্ভিস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আলাদা কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালীকরণ, দুর্নীতি রোধ, বিনিয়োগ আকর্ষণ, জবাবদিহিতা বৃদ্ধি সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অসমতা ও আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করা; নির্বাহী বিভাগের ওপর সংসদীয় তদারকি বৃদ্ধিকরণ, সংবিধানের মূলনীতি ও সংশ্লিষ্ট আইনের আলোকে নজরদারি কাজের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা হবে কমিশনের কাজ।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন