জোর করে করোনা রোগী বানানোর হীনচেষ্টা, চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু, দেয়নি লাশও
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সংবাদদাতা: আনারুল হক আনোয়ার। গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সতের রশিয়া। থাকতেন রাজধানীর শ্যামলীতে। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল কোয়ার্টারে। স্ত্রী ছিলেন সিনিয়র স্টাফ নার্স। দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে মারা যান মাস তিনেক আগে।
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিভিন্ন পরতে পরতে যে অনিয়ম-অযত্ম-অবহেলা এবং দায়িত্বহীনতা রয়েছে, তার ফের প্রমাণ মিললো সমাজকর্মী আনোয়ারের বেলায়। মরদেহ স্বজনদের কাছে দেয়া হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একগুঁয়েমি করে পাত্তাই দেয়নি স্বজনদের।
স্বজনদের অভিযোগ, আনোয়ারকে ‘জোর করে’ দাফন করা হয়েছে করোনা সন্দেহে। অথচ, সরকারের পক্ষ থেকে বরারবরই বলা হচ্ছে, রোগিদের দরকারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। তারপরই নেয়া হচ্ছে নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা।
আনারুল হক আনোয়ার অসুস্থ হয়ে বাসায় পড়ে গিয়েছিলেন। পরে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে জ্বর-ঠান্ডা-কাশি নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ১ এপ্রিল। তার স্ট্রোক হয়েছিল বলেও পরিবারের সদস্যরা ধারনা করছেন।
তার ছোট ভাই মাসুদ হক অভিযোগ করেছেন, মৃত্যুর পর ৩ দিন পার হলেও এখনও মৃত্যু সনদ দেওয়া হয়নি।
এদিকে আনোয়ারের করোনাভাইরাস পরীক্ষার যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, সেখানে আরেকজনের নাম রয়েছে। তার বয়সও ভিন্ন। ঢাকা শিশু হাসপাতালের গবেষণাগারে পরীক্ষার পর তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে কোভিড-১৯ ধরা পড়েনি।
পুরো বিষয়টি সম্পর্কে আনোয়ারের ঘনিষ্ট নাজমুল হক মানিক জানান, হাসপাতালে ভর্তি প্রক্রিয়ার পুরো সময় তিনি সঙ্গে ছিলেন। পরবর্তী সময়কালেও হাসপাতালে ছিলেন তিনি। কিন্তু হাসপাতালে আনোয়ারের কোনো চিকিৎসাই দেয়া হয়নি। ডাক্তারও কাছে ঘেঁষেনি। বলা যায় বিনা চিকিৎসাতেই মারা গেছেন তিনি।
মাসুদ বলেন, বুধবার রাতে তার ভাইয়ের মুখ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। শিশু হাসপাতাল থেকে একটি টিম এসে নমুনা নিয়ে যায়। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের কোনো ডাক্তার কিংবা নার্স চিকিৎসা দিতে আসেনি। বুধবার সন্ধ্যার পর একজন নার্স এসে বলেছিল ২ টি ট্যাবলেট খাওয়াতে। কিন্তু ট্যাবলেট খাবার মতো অবস্থা ছিল না রোগীর। নার্সকে বলেছিলাম, স্যালাইন কিংবা তরল ওষুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে। ডাক্তারদের কাছেও অনেক অনুরোধ করেছি। কেউ এগিয়ে আসেনি চিকিৎসা দিতে।
এভাবেই বিনা চিকিৎসায় রাত ১২ টার দিকে আমার হাতের ওপরই মারা যান ভাই। ওই মুহূর্তেও ডাক্তার-নার্স ডেকে পাইনি। তারা বলে, কাছে এসে মরবো নাকি! অনেক ডাকাডাকির পর প্রায় ১০ মিনিট পর একজন ডাক্তার এসে বলে যান, রোগী মারা গেছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাসুদ বলেন, মারা যাবার পর একটা চাদর চেয়েছিলাম লাশ ঢাকার জন্য। সেটাও দেয়া হয়নি।
তিনি বলেন, রাতে মরদেহ বুঝিয়ে দেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আমি একা অসহায় অবস্থায় ছিলাম হাসপাতালে। পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে তাকে জানানো হয়, মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে না। খিলগাঁও তালতলা কবরস্থানে দাফনের জন্য দিয়ে দেওয়া হবে। এজন্য কিছু কাগজপত্রে তার সই চান কর্তব্যরত চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা।
‘কিন্তু সই দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়। কাগজগুলো ছুঁইড়া ফেলে দেয়। বলে, তুই সই দিলেও লাশ নিয়ে যাব, না দিলেও লাশ নিয়ে যাব। দরকার হলে র্যাব-আর্মি ডাকবো। ওইখানে তো আমার কেউ নাই। বাধ্য হয়ে সই দিয়েছি। তারা আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে।’- বলেন মাসুদ হক। মাসুদ অভিযোগ করেন, কবরস্থান পর্যন্ত যেতে চাইলেও তাকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি।
“আমি বললাম – লাশ তো দিলেন না, অন্তত গোরস্তানে যেতে দেন। তারা বলল নেওয়া যাবে না, আমার পোশাক নাই। গাড়িতে আমাকে দিয়া লাশ তোলাইল। বলল জানাজা করতে নিয়া যাব। কিন্তু নিয়া গেল না। বললাম, ভাইয়ের দাফনের সময় পাশে থাকি। কিন্তু তারা আমাকে সেই গাড়িতে নেয়নি। বলে অন্য গাড়িতে আসতে। কিন্তু অনেকক্ষণ পর একটা গাড়ি পাইয়া ফোন দিছি। বলে দাফন করা হয়ে গেছে। এই দুঃখ সারাজীবন ভুলতে পারব না।”
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন