সাস নিউজ : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। বহুল আলোচিত এই মামলাটি ছাড়াও তার বিরুদ্ধে আরো ৩৫টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
বৃহস্পতিবার পুরান ঢাকার বকশিবাজারের বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক আখতারুজ্জামান জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদাকে এই রায় দেয়।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী জাকির হোসেন ভুঁইয়া জানান, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা মোট ৩৬টি। ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা আছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
মামলাগুলোর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আইনজীবী জাকির হোসেন ভুঁইয়া জানান, ১৬টি মামলার অভিযোগ গঠন হয়ে বিচারের আদেশ দিয়েছেন বিচারিক আদালত। তবে এই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত ১১টির বিচার স্থগিত করেছে।
তিনি আরো জানান, বাকি ২০টি মামলার কোনোটিতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়েছে, কোনোটি তদন্তের পর্যায়ে আছে। এসব মামলার মধ্যে দুর্নীতির মামলা আছে পাঁচটি। এছাড়া দেশের বিভিন্ন আদালতে হত্যায়, সহিংসতা, নাশকতায় নির্দেশ, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির মামলা বাকিগুলো।
বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পাঁচটি দুদকের করা মামলা, বাকিগুলো হত্যা, নাশকতা ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়াসহ রাষ্ট্রদ্রোহের অভিয়োগে করা রয়েছে।
যেসব মামলায় স্থগিতাদেশ নেই তার মধ্যে ১৪টির বিচার চলছে পুরান ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে। গত ৮ জানুয়ারি এ বিষয়ে একটি আদেশ জারি করেছে আইন মন্ত্রণালয়।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলাগুলোর মধ্যে চারটি সেনা সমর্থিত ২০০৭ সালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা। বাকি দুর্নীতির মামলাসহ অপরগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়ের করা।
দুদকের করা মামলাগুলো হচ্ছে- জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা, বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলা ও নাইকো দুর্নীতি মামলা।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা: জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলাটি করে দুদক। বিচারিক কার্যক্রম শেষে বৃহস্পতিবার এ মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান। তারেক রহমানসহ অন্যান্য আসামীদের ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা: ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ৮ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এ মামলাটি করে দুদক। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। এই মামলাটি এখন যুক্তিতর্ক পর্যায়ে রয়েছে।
গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর দুদকের উপপরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী গ্যাটকো দুর্নীতি মামলাটি করেন। মামলায় ১৪ কোটি ৫৬ লাখ ৩৭ হাজার ৬১৬ টাকা দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। এতে খালেদা জিয়া, তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোসহ ১৩ জনকে মামলার এজাহারে আসামি করা হয়। মামলা হওয়ার পরদিনই খালেদা ও কোকোকে গ্রেফতার করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর মামলাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয় জরুরি ক্ষমতা আইনে। পরের বছর ১৩ মে খালেদা জিয়াসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেয়া হয়।
উচ্চ আদালতে স্থগিত থাকার পর ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে বিচারিক আদালতে বিচার শুরুর নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। এই মামলায় আগামী ৪ মার্চ অভিযোগ গঠনের শুনানি আছে।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি দুর্নীতি মামলা: চীনা প্রতিষ্ঠান কনসোর্টিয়াম অব চায়না ন্যাশনাল মেশিনারিজ ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশনের (সিএমসি) সঙ্গে বড় পুকুরিয়া কয়লা খনির উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের প্রায় ১৫৮ কোটি ৭১ লাখ টাকার ক্ষতির অভিযোগ আনা হয় এ মামলায়।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া এবং তার মন্ত্রিসভার ১০ সদস্যসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে এ দুর্নীতি মামলা করা হয়।
ওই বছরের ৫ অক্টোবর ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে দুদক। মামলাটির কার্যক্রম দীর্ঘদিন উচ্চ আদালতে স্থগিত থাকলেও গত বছর ২৮ মার্চ স্থগিতাদেশ তুলে নেয় উচ্চ আদালত। তবে এই মামলাটির অভিযোগ গঠন হয়নি এখনও। একাধিকবার পিছিয়েছে অভিযোগ গঠনের শুনানি।
নাইকো দুর্নীতি মামলা: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় খালেদা জিয়া গ্রেফতার হওয়ার পর ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায় এই মামলা করে দুদক। পরের বছর ৫ মে খালেদা জিয়া ও দলের নেতা মওদুদ আহমদসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়।
এতে বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর হাতে তুলে দেয়ার মাধ্যমে আসামিরা রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করেছেন।
দীর্ঘ স্থগিতাদেশ শেষে ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ মামলাটির বিচার শুরুর আদেশ দেয় উচ্চ আদালত। ১৫ জানুয়ারি এই মামলা থেকে খালেদা জিয়ার অব্যাহতি চেয়ে আবেদন জানানো হয়। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি এই আবেদনের ওপর শুনানি হবে।
সোনালী ব্যাংক বনাম ড্যান্ডি ডাইং ঋণ খেলাপি মামলা: ৪৫ কোটি ৫৯ লাখ ৩৭ হাজার ২৯৫ টাকা ঋণ খেলাপির অভিযোগে ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর ঢাকার প্রথম অর্থঋণ আদালতে মামলাটি করেন সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় শাখার সিনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম। মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।
খালেদা জিয়া ছাড়াও এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান এবং তার দুই মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমান, প্রয়াত সাঈদ এস্কান্দারের ছেলে শামস এস্কান্দার ও সাফিন এস্কান্দার, মেয়ে সুমাইয়া এস্কান্দার, স্ত্রী বেগম নাসরিন আহমেদ, গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, মামুনের স্ত্রী শাহীনা ইয়াসমিন, কাজী গালিব আহমেদ, মিসেস শামসুন নাহার ও মাসুদ হাসান, প্রয়াত বিবাদী মোজাফফরের স্ত্রী শামসুন্নাহার এবং ছেলে মাসুদ হাসান।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা: ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের সমাবেশে এই গ্রেনেড হামলা হয়। যার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই মামলার অন্যতম আসামি তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া
বসুন্ধরা গ্রুপের ২১ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন সম্পর্কিত দুর্নীতি মামলা: সাব্বির হত্যার পর বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে ২১ কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। রমনা থানায় হওয়া মামলাটি এখনো বিচারাধীন রয়েছে।
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের অভিযোগে দুর্নীতি মামলা: ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কাফরুল থানায় বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪১ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়, যার বিচার কার্যক্রম এখনো চলছে।
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা: মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের মোট সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করায় ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. মোমতাজ উদ্দিন আহমদ মেহেদী। এই মামলার শুনানি পিছিয়ে ১০ এপ্রিল দিন ধার্য করা হয়েছে।
হত্যা, নাশকতা ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ায় মামলা: ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন চলাকালে ও নির্বাচন পরবর্তী বছরব্যাপী বিএনপির আন্দোলনে বাসে অগ্নিসংযোগ, হত্যা, নাশকতা ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে বিএনপির বিভিন্ন নেতাকর্মীর পাশাপাশি নির্দেশদাতা হিসেবে মামলা করা হয় বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে হওয়া এই মামলাগুলোর মধ্যে ঢাকায় হওয়া মামলাগুলো ১০ মামলার জন্য ১২ মার্চ ও ১০ এপ্রিল শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।
এই মামলাগুলো মধ্যে দুর্নীতির অধিকাংশ মামলা এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আসামি হিসেবে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক জিয়া। বিদেশে থেকে দেশে নাশকতার পরিকল্পনা করার অভিযোগেও তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন