১০ লাখ কোটি টাকা প্রবাসী আয়ের করুণ কাহিনী
সাস নিউজ২৪ ডট কম : গত ৪০ বছরে বাংলাদেশে ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৩২ কোটি টাকার প্রবাসী–আয় এসেছে। কিন্তু এই প্রবাসী–আয়ের পেছনে আছে বহু করুণ কাহিনি। একটু বেশি আয়ের জন্য বিদেশে অমানুষিক পরিশ্রম করতে গিয়ে প্রায়ই বাংলাদেশিরা প্রাণ হারাচ্ছেন। অল্প বয়সে মারা যাচ্ছেন শ্রমিকেরা। গত এক দশকে প্রায় ২৫ হাজার প্রবাসীর লাশ এসেছে। শ্রমিকেরা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, হৃদ্রোগ, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। কিছু ক্ষেত্রে আত্মহত্যা ও খুনের ঘটনা ঘটে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (তথ্য) অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ৯৮ লাখ ৮৯ হাজার ৫৫৫ জন বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গেছেন।
সৌদি আরবপ্রবাসী মোহাম্মদ আবুল (২৯), কাতারপ্রবাসী হাফিজুর রহমান (৩১), দুবাইপ্রবাসী জাহিদ হাসান (৩২) ও মালয়েশিয়াপ্রবাসী এ কে এম আবু সাইদ (৩৫)। ভাগ্য বদলানোর জন্য গন্তব্য ভিন্ন হলেও এই চার যুবক মারা গেছেন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে। গত বছরের ডিসেম্বরে এই চারজনের লাশ দেশে আসে।
একই মাসে জর্ডানের শহিদুল (৩৮) আগুনে পুড়ে, কাতারের আতিকুল ইসলাম (৩৬) বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এবং সৌদি আরবের মনিরুজ্জামান খান (৩১) ও মালয়েশিয়ার হোসেন আলী (৩২) মারা যান হৃদ্রোগে।
কেবল এই আট যুবকই নন, গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যে ২২০ জন প্রবাসীর লাশ এসেছে, তাঁদের মধ্যে ১৮২ জনই (৮৩ শতাংশ) মারা গেছেন অস্বাভাবিকভাবে। একইভাবে ২০১৫ সালে বিদেশ থেকে মোট এসেছে ৩ হাজার ৩০৭ জন প্রবাসীর লাশ। আর গত এক দশকে লাশ হয়ে ফিরেছেন ২৫ হাজার ২২৯ জন প্রবাসী।
বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় ৯০ লাখ বাংলাদেশি কাজ করেন। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করছেন প্রায় ৫০ লাখ। সৌদি আরবফেরত নির্মাণশ্রমিক টাঙ্গাইলের সাখাওয়াত হোসেন, আবদুল কাদের, মালয়েশিয়াফেরত আল আমিন, সংযুক্ত আরব আমিরাতফেরত মশিউর রহমানসহ কয়েকজন প্রবাসী এবং বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন এমন কয়েকজন বাংলাদেশি বললেন, নির্মাণ, উৎপাদনসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করা বাংলাদেশিরা অধিকাংশই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করে যে পরিবেশে গাদাগাদি করে তাঁরা থাকেন, সেটিও চরম অস্বাস্থ্যকর। স্বজনহীন এসব প্রবাসী সব সময় দেশে টাকা পাঠানোর চিন্তায় থাকেন। ফলে প্রায়ই তাঁরা হৃদ্রোগ কিংবা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যান।
অভিবাসন–বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, প্রবাসে শ্রমিকদের সবাই কমবেশি ঝুঁকিতে থাকেন। একাকী প্রবাস জীবন, সব সময় দুশ্চিন্তা, কাজের নিম্ন পরিবেশ—এসব কারণে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে ৩০ বা ৩৫ বছর বয়সের একজন মানুষ হৃদ্রোগ বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যাচ্ছেন। অথচ এই বয়সের একজন মানুষের মারা যাওয়া মোটেও স্বাভাবিক নয়। এর পাশাপাশি এখন যোগ হয়েছে নারী শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ সালে ১ হাজার ৪০২, ২০০৭ সালে ১ হাজার ৬৭৩, ২০০৮ সালে ২ হাজার ৯৮, ২০০৯ সালে ২ হাজার ৩১৫ জন, ২০১০ সালে ২ হাজার ৫৬০, ২০১১ সালে ২ হাজার ৫৮৫ জন, ২০১২ সালে ২ হাজার ৮৭৮ জন, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৭৬ জন, ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৩৩৫ জন এবং ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৩০৭ জন প্রবাসীর লাশ এসেছে। এর মধ্যে ২২ হাজার ৬৫১ জনেরই লাশ এসেছে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে।
এর মধ্যে ৫ হাজার ৭৩১ জনেরই লাশ এসেছে সৌদি আরব থেকে। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২ হাজার ৫২০ জন, কুয়েত থেকে ২ হাজার ১৮৪ জন, ওমান থেকে ১ হাজার ১০২ জন, বাহরাইন থেকে ৫৩৪ জন এবং কাতার থেকে ৪৮৬ জনের লাশ এসেছে। অর্থাৎ, ৬১ শতাংশ লাশই এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক সেলিম রেজা বলেন, দক্ষ কর্মী পাঠানো গেলে সমস্যা কমবে। শ্রমিক প্রেরণ ও গ্রহণকারী উভয় দেশ চাইলে কর্মপরিবেশ ভালো করা সম্ভব।
মন্তব্য
মন্তব্য করতে নিবন্ধন অথবা লগইন করুন